কারাগারেই নিরাপদ আশ্রয়

ডেস্ক রিপোর্ট: সারা দেশে চলমান মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে আটক কিংবা এ অভিযান শুরু হওয়ার আগে মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিরা কারাগারকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করছেন। ফলে তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হওয়াটাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে সেখানেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এতে দেশের কারাগারগুলোতে বন্দীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।

কারা সূত্র জানায়, এমনিতেই প্রতিটি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ, কোনো কোনো কারাগারে তিনগুণ বন্দী রাখা হয়েছে। গত ১২ মে সারা দেশের কারাগারে মোট বন্দীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৭ হাজার। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গতকাল যার সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার ৮০০। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গতকাল পর্যন্ত বন্দীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজারেরও বেশি। মোট বন্দীর মধ্যে বেশির ভাগই অর্থাৎ ৬৫ ভাগই মাদক মামলার আসামি।

কারা অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, চলমান মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের কারণে বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারেই বন্দীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অনেকেই বর্তমানে হয়তো কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছেন। অভিযানে ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক মারা গেছেন। একই সময় আটক হয়েছেন কয়েক হাজার মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী। গত ৪ মে থেকে এ অভিযান শুরুর পর সরকারের তরফ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। গত ৩ মে চট্টগ্রামের হালিশহর থানার শান্তিবাগ শ্যামলী আবাসিক এলাকার জেড এস এঞ্জেন্স বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আশরাফ আলী ও হাসান নামে দুজনকে গ্রেফতার করে সিএমপি ডিবি। পরদিন রাজধানীর শ্যামপুর থানার পোস্তগোলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তাইজুল খান ও এমরানুল হক নামে দুজনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। ২০ মে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বাবুল আলম, আয়াতুল্লা, হেলাল উদ্দিন ও মোতালেব নামে চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত মাসের মাঝামাঝিতে কালশী বিহারি ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী কালু ওরফে কাল্লুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে চলমান অভিযানে কঠোরতার কারণে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জামিনের চেষ্টা করা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামিন নিয়ে বাইরে আসার চেয়ে তারা কারাগারে থাকাকেই নিরাপদ মনে করছে। গতকাল পর্যন্ত তাদের পক্ষে কেউ জামিনের জন্য আদালতে আবেদন করেননি।

দুই মাস আগে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য উজ্জ্বলকে তার ওয়ারীর বাসা থেকে টেকনাফের এক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীসহ গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) গেণ্ডারিয়া সার্কেলের একটি দল। একই দল এর কয়েক দিন পর সূত্রাপর থানার ছাত্র সংগঠনের সাবেক সভাপতি জিকুকে ৫৫ পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। তবে তাদের কেউই জামিনের জন্য তৎপরতা দেখাননি। এ দুজনই র‌্যাব-পুলিশ এবং ডিএনসির নজরদারিতে ছিলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ দুজনের কেউই রহস্যজনক কারণে জামিনের জন্য তৎপরতা দেখাচ্ছেন না। গেণ্ডারিয়া সার্কেলের পরিদর্শক হেলাল উদ্দীন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল জিকু এবং উজ্জ্বলের কাছে আরও অনেক বড় চালান ছিল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযানে কক্সবাজার এলাকায় গ্রেফতার মাদক ব্যবসায়ীদের জামিন আবেদন কমে গেছে। অনেকেই কারাগারকেই নিরাপদ মনে করে সেখানে থাকতে চাচ্ছেন। এর সত্যতা মিলেছে জেলা কারাগারের প্রধান বজলুর রশীদ আখন্দ ও পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে কথা বলে। কক্সবাজারের জেলসুপার বজলুর রশীদ আখন্দ বলেন, অভিযান শুরুর পর আসামিদের জামিন আবেদন বা মুক্তির জন্য চেষ্টা-তদবির কমে গেছে। কক্সবাজার কারাগারে মোট বন্দীর সংখ্যা তিন হাজার ১৭৩ জন এবং মোট বন্দীর মধ্যে বেশির ভাগই অর্থাৎ ৬৫ ভাগই মাদক বিশেষ করে ইয়াবা মামলার আসামি। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর আগে গড়ে প্রতিদিন ১৫-২০ জন জামিনের আবেদন জানাত আদালতে বা তারা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু গত কয়েক দিন আসামিদের পক্ষে এ ধরনের তৎপরতা একেবারেই কমে গেছে।

কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ আহমেদ বলেন, ব্যাপক অভিযানের কারণে আদালতে জামিন আবেদন প্রায় নেই বললেই চলে। অভিযানের আগে প্রতিদিন ২০-২২টি জামিন আবেদনের শুনানি হতো জেলা দায়রা জজ আদালতে, যা এখন কয়েকটিতে নেমে এসেছে। তবে মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তারা সক্রিয় ও উদ্যোগী হলে এমন পরিস্থিতি হতো না বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার ভয় আর আতঙ্কে মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিরা এখন আর জামিনের আবেদন বা মুক্তির চেষ্টা করতে রাজি হচ্ছেন না। প্রতিদিন যে পরিমাণ মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী গ্রেফতার হচ্ছেন সেই তুলনায় জামিন আবেদন নেই বললেই চলে। অপর একজন আইনজীবী জানান, আসামিদের জামিনের জন্য তাদের পক্ষে যারা আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন তাদেরই এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
আইনজীবীরা জানান, মাদক মামলার অনেক আসামি এখন কারাগারকেই নিরাপদ জায়গা বলে মনে করছেন। বাইরে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। তাই অনেকেই মনে করছেন, এ সময়টা কারাগারেই থাকি। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন