তিন ক্লু নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ

shahjahan bacchuমুন্সিগঞ্জ: সিরাজদিখানে বিশাকা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, লেখক ও জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার কোনো মোটিভ উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রহস্য উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা তদন্তে মাঠে নেমেছে। লেখালেখির কারণে বা বিরূপ কোনো প্রকাশনার কারণে তাকে হত্যা করা হতে পারে- এমন কোনো কারণ খুঁজে পায়নি মুন্সিগঞ্জের পুলিশ।

লেখালেখির কারণে বা বিরূপ কোনো প্রকাশনার কারণে তাকে হত্যা করা হতে পারে- এমন কোনো কারণ খুঁজে পায়নি মুন্সিগঞ্জের পুলিশ। তবে, জেলা পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, নিহত শাহজাহান বাচ্চুর দুই স্ত্রী এবং তাদের ঘরে সন্তান এবং ঢাকায় দুইটি বাড়ি রয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে শাহজাহান বাচ্চু গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের কাকালদি গ্রামেই থাকতেন।

দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে শাহজাহান বাচ্চুর বসবাস এবং ঢাকায় তার দুইটি বাড়ি, বাচ্চুর বংশগত পরিচয় এবং ফেসবুকে লেখার কারণে জঙ্গিরা এঘটনা ঘটিয়েছে-এমন তিন কারণ নিয়ে পুলিশ তদন্তে নেমেছে বলে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম জানিয়েছেন। শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনায় মঙ্গলবার সকালে তার স্ত্রী আফসানা জাহান বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এদিকে, নিহত শাহজাহান বাচ্চুর দুই স্ত্রীর ঘরে চার সন্তান রয়েছে। সিরাজদিখানের কাকালদি গ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে আঁচল জাহান এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং ছেলে বিশাল নবম শ্রেণিতে পড়ে।

ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে প্রথম স্ত্রীর ঘরে বড় মেয়ে বিপাশা জাহান গৃহিণী এবং ছোট মেয়ে দূর্বা জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার ইফতারের আগমুহূর্তে সিরাজদিখান উপজেলার মুন্সিগঞ্জ-শ্রীনগর সড়কের কাকালদি তিন রাস্তার মোড়ে আনোয়ার সর্দারের ওষুধের দোকানের সামনে ছিলেন শাহজাহান বাচ্চু। এ সময় সড়কের পূর্বদিক থেকে দুইটি মোটরসাইকেলে করে ৪ হেলম্যাড পরা চার যুবক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর বাচ্চুর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখে দুবৃর্ত্তরা সড়কের উত্তরদিক দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।

ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ শাহজাহান বাচ্চুকে উদ্ধার করে সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যায়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মঙ্গলবার দুপুরে বাচ্চুর মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে, বাচ্চু নিহতের ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জ প্রেস ক্লাব সড়কে জেলা কমিউনিস্ট পার্টি মানববন্ধন করে। এ সময় জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শ.ম. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক হামিদা খাতুন হত্যাকারীদের শনাক্তসহ দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

এদিকে, বগ্লার ও লেখক বাচ্চু হত্যার খবর পেয়ে সোমবার গভীর রাতে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে কাউন্টার টেররিজমের একটি ইউনিট সিরাজদিখানে আসেন এবং নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘসময় কথা বলেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলেন এবং সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেন।

লেখালেখির কারণে তাকে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বিভিন্ন সময় হুমকি প্রদান করে বলে জানিয়েছেন বাচ্চুর স্বজনরা। তবে ঠিক কী কারণে, কারা তাকে হত্যা করেছে তা জানেন না তার স্বজনরা। বাচ্চুর দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে আঁচল জাহান জানায়, তার বাবার দোষ ছিল তিনি লেখালেখি করতেন। গ্রামে তার কোনো শত্রু ছিল না। তার বাবা হত্যার বিচার চান।

বাচ্চুর প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে দূর্বা জাহান জানায়, তার বাবাকে উগ্র মৌলবাদীরা নাকি অন্য কেউ হত্যা করেছে তা তাদের জানা নেই। পুলিশের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

নিহত বাচ্চুর দ্বিতীয় স্ত্রী আফসানা জাহান জানান, ঘটনার সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। স্বামীকে ঘরে রেখেই বাইরে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় এসে দেখেন তার স্বামী আর বেঁচে নেই। এলাকায় তার স্বামীর সঙ্গে কারো বিরোধ ছিল না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হামিদা খাতুন বলেন, শাহজাহান বাচ্চু জেলা কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় নেতা ও মুক্তমনার মানুষ ছিলেন। তার লেখনীতে সাহসি ভূমিকা ছিল। জেলা কমিউনিস্ট পার্টি এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও হত্যাকারীদের আটকের দাবির কথা বলে এই নারী নেত্রী আরো বলেন, বর্তমান সরকার বলছে দেশে জঙ্গিবাদ নেই। আসলে জঙ্গিবাদ দেশে আছে। আর আছে বলেই একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করা হচ্ছে, সরকার তার বিচার করছে না।

সিরাজদিখানের মধ্যপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আব্দুর রহিম জানান, বাচ্চু একজন লেখক ও সাদাসিধে একা একা ঘুরতো। গত তিনবছর ধরে গ্রামেই থাকছে। কে বা কারা এবং কেন তাকে হত্যা করা হলো তা পুলিশের তদন্তেই বের হয়ে আসবে।

মুন্সিগঞ্জের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিহত বাচ্চু তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে হুমকি দেয়ার কথা বলতেন। কিন্তু এই বিষয়ে থানা বা পুলিশকে কখনো জানানো হয়নি। এলাকায় তার কোনো শত্রু নেই। কোনো ব্লগেও তিনি ছিলেন না, ফেসবুকে তার কিছু লেখালেখি আছে। তার বিরূপ কোনো লেখা নেই এবং নামকরা কোনো প্রকাশনাও নেই। প্রকাশনা সংস্থায়ও তিনি যেতেন না। তার প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে দূর্বা জাহান প্রকাশনা সংস্থা ভাড়া দিয়ে টাকা নিতো।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানেই দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে তিনি থাকতেন। এখানে কারও সঙ্গে তিনি মিশতেন না। ছোট একটি কক্ষেই বাচ্চু থাকতেন। বাচ্চুর পারিবারিক পরিচয় তার বাবা মুক্তিযুদ্ধেও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি এবং তার এক ভাই সাইদও সদস্য ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাবা ও ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি কয়েক বছর ধরে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে শাহজাহান বাচ্চুর বসবাস এবং ঢাকায় তার দুটি বাড়িসহ নানা বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জের এই পুলিশ সুপার।