চৌগাছায় ৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগে জটিলতা

চৌগাছা প্রতিনিধি : যশোরের চৌগাছায় বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম প্রহরী পদে চাকুরি পাওয়ার আশায় লাখ লাখ টাকা দিয়েও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন যশোরের চৌগাছার ২১ চাকুরি প্রার্থী। পাঁচ বছর পার হতে চললেও তারা নিয়োগ বা টাকা ফেরৎ কোনটিই পাচ্ছেন না। অন্যদিকে চাকুরির আশায় বিভিন্ন নেতাদের কাছে ধর্না দিলেও চাকুরি বা টাকা ফেরতের কোন নিশ্চয়তা না পেয়ে হতাশায় ভূগছেন তারা। চাকরি পেতে হাইকোর্টে একটি রীট আবেদন করেছেন ১৭ প্রার্থী। এই রিটের ফলে ৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা ও নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে উপজেলার ২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম প্রহরী পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে সময়ের বাছাই ও নিয়োগ কমিটি ৭ অক্টোবর-২০১৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জারীকৃত নীতিমালার আলোকে আবেদনকারীদের থেকে বাছাই পূর্বক ২১ জনকে চুড়ান্ত করে একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এই চুড়ান্ত তালিকা নিয়োগের জন্য শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে নিয়োগ অনুমোদন কর্তৃপক্ষ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে পাঠায়।

২১টি স্কুলের চুড়ান্ত হওয়া ও নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীরা ছিলেন খড়িঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মতিয়ার রহমান, রায়নগরে মোশারফ হোসেন, বুন্দেলিতলায় আজিজুর রহমান, বেড়গোবিন্দপুরে মাহমুদুল হাসান, বড়খানপুরে সাদ্দাম হোসেন, রাণীয়ালিতে জয়দেব কুমার সরকার, মাশিলায় আলমগীর হোসেন, গয়ড়াতে মুসা হারুন, স্বরুপদাহে মফিজুর রহমান, হাউলিতে সুনিতোষ কুমার বিশ্বাস, শাহাজাদপুরে আবু বক্কর সিদ্দিক, সুখপুকুরিয়াতে ফারুক হোসেন, সৈয়দপুরে উজ্জল মিয়া, যাত্রাপুরে বাদশা মিয়া, জগদীশপুরে আনোয়ার হোসেন, নিউ আড়কান্দিতে সাইফুল ইসলাম ও কাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনোয়ার হোসেন, এছাড়া দক্ষিন-বল্লভপুর, দেবিপুর, বাদেখানপুর ও পুড়াহুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে প্রার্থী চুড়ান্ত হয়।

২১ জনের নিয়োগে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রার্থী প্রতি চার থেকে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনির তৎকালিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুষমা সুলতানাকে ধীরে চলতে নির্দেশ দেন। এরইমধ্যে ২৬ জানুয়ারী-২০১৫ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রে নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করে নিয়োগ ও বাছাই কমিটি পরিবর্তন করা হয়। একই সাথে নীতিমালার ৭(২) ধারা পরিবর্তন করা হয়। পূর্বে ছিল ‘‘বাছাই ও নিয়োগ কমিটি বৈধ আবেদনকারীদের ২০ নম্বরের পরীক্ষা গ্রহণপূর্বক শারীরিকভাবে যোগ্য ৩ (তিন) জনের একটি প্যানেল প্রস্তুত করে নিয়োগ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করবে।’’ এটির সাথে সংযুক্ত করা হয় ‘‘উক্ত তালিকা হইতে মাননীয় সংসদ সদস্য একজনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করিবেন। মাননীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশই চুড়ান্ত বলিয়া গন্য হইবে। সুপারিশ প্রাপ্তির পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনোনীত প্রার্থীর নাম সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পত্রযোগে জানাইয়া দিবেন।’’

সংযুক্ত সংসদ সদস্যদের এই নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে নাটোরের জনৈক ব্যক্তি দপ্তরী কাম প্রহরী নিয়োগ নীতিমালার ৭(২) ধারা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন (৩৪৫৮/২০১৫) দায়ের করেন। ফলে সারা দেশের ন্যায় চৌগাছায়ও নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়ায় ২১ যুবকের চাকুরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবুও তারা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের আশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকেন।

এরপর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ হাইকোর্ট রিট পিটিশন নম্বর ৩৪৫৮/২০১৫ মামলার রুল অ্যাবসুলেট মর্মে রায় প্রদান করে। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ১০ জানুয়ারী ২০১৭ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসরিন জাহান স্বাক্ষরিত পত্রে রায়ের বিরুদ্ধে আপীল না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ২০১৫ সালে সংশোধিত দপ্তরী কাম প্রহরী নিয়োগ নীতিমালার ৭(২) ধারা বাতিল পূর্বক পূর্ববর্তী বিধিবিধান অনুসরন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচলককে নিয়োগদানের নির্দেশনামূলক পত্র দেয়া হয়।

১২ জানুয়ারী ২০১৭ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (আইন কোষ) ড. মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে জেলা শিক্ষা অফিসারদেরকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরন করে নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-২ অধিশাখার যুগ্ম সচিব কেএম রুহুল আমীন স্বাক্ষরিত পত্র ও নিদের্শনা মোতাবেক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নার্গিস পারভীন ৭ আগস্ট ২০১৭ দপ্তরী কাম প্রহরী পদে আবেদন চেয়ে পূর্বের ২১ টিসহ উপজেলার ৪১টি বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম প্রহরী পদে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন।

প্রত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে দৌড়ঝাপ শুরু হয় সংশ্লিষ্ট সাবেক ও বর্তমান সভাপতি এবং ভুক্তভোগী প্রার্থীদের। ৭ আগস্ট-১৭’ চাকুরি প্রার্থী ২১ ব্যক্তি চৌগাছা সদর ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে সাথে করে নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে যান। নির্বাহী অফিসার নার্গিস পারভীন বিধি অনুযায়ী কিছু করার নেই বলে তাদের জানান। ১৫ আগস্ট স্থানীয় এমপি মনিরুল ইসলামের কাছে আগের সুপারিশ বহাল রেখে নিজেদের চাকুরির জন্য আবেদন নিবেদন করেন।

এসময় তিনি পূর্বে কোন টাকা লেনদেন হলে তা ফেরৎ নিলে বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দেন। ওদিকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক আবেদনপত্র গ্রহণ করে তাদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার তারিখও চুড়ান্ত করে।

চাকুরি প্রার্থী যুবকরা কোনভাবে আস্বস্ত না হতে পেরে আদালতের আশ্রয় নেন। চাকুরি প্রার্থী ১৭ জন হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন ১৬৭৪৪/২০১৭ দায়ের করেন। রিট আবেদনকারীরা হলেন খড়িঞ্চা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মতিয়ার রহমান, রায়নগরে মোশারফ হোসেন, বুন্দেলিতলায় আজিজুর রহমান, বেড়গোবিন্দপুরে মাহমুদুল হাসান, বড়খানপুরে সাদ্দাম হোসেন, রাণীয়ালিতে জয়দেব কুমার সরকার, মাশিলায় আলমগীর হোসেন, গয়ড়াতে মুসা হারুন, স্বরুপদাহে মফিজুর রহমান, হাউলিতে সুনিতোষ কুমার বিশ্বাস, শাহাজাদপুরে আবু বক্কার সিদ্দিক, সুখপুকুরিয়াতে ফারুক হোসেন, সৈয়দপুরে উজ্জল মিয়া, যাত্রাপুরে বাদশা মিয়া, জগদীশপুরে আনোয়ার হোসেন, নিউ আড়কান্দিতে সাইফুল ইসলাম ও কাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনোয়ার হোসেন।

সেখানে বিবাদি করা হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল, যশোরের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, চৌগাছার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে। হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্যাহ এর হাইকোর্ট বেঞ্চ ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ বিবাদিগণকে জবাব প্রদান পূর্বক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশনা পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় আগের চুড়ান্ত হওয়া ২১টির সাথে পরে বিজ্ঞপ্তি দেয়া ২০টিসহ মোট ৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরইর দপ্তরী নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয়। ফলে চুড়ান্ত প্রক্রিয়ায় থাকা ২১ প্রার্থীসহ সকল প্রার্থীর ভাগ্যই ঝুলে গেছে।

একটি সূত্র দাবি করেছে সম্প্রতি আগের চুড়ান্ত হওয়া প্রার্থীরা যাদের কাছে টাকা দিয়েছিলেন সেইসব সভাপতিদের উপর টাকা ফেরতের জন্য চাঁপ সৃষ্টি করে ধর্না দিচ্ছেন। অবশ্য ওইসকল সভাপতিরা তাদের অস্বস্ত করেছেন কয়েকদিনের মধ্যে রিট মামলাটির নিস্পত্তি হয়ে যাবে, সেই সাথে তোমাদের নিয়োগও সম্পন্ন করা হবে। বিষয়টি এখন চৌগাছার ‘টক অব দ্যা শহর’ হয়েছে। তবে নিয়োগের আশায় ওইসকল প্রার্থীরা উদ্ধৃত হতে চাননি।

এ বিষয়ে চৌগাছা উপজেলা শিক্ষা অফিসার বেলায়েত হোসেন বলেন, বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষার দিন তারিখ চুড়ান্ত করা হয়েছিল। পরে আদালতের আদেশ পেয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমারা জবাব দাখিল করেছি। তিনি বলেন আমরা আদালতকে অবহিত করেছি, তারা যেহেতু সে সময়ে নিয়োগ পাননি। আর নিয়োগ পাওয়ার আগেই নীতিমালা পরিবর্তন হয়েছে। এ কারনে নতুন নীতিমালার আলোকে ৪১টি বিদ্যালয়ের নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। তিনি বলেন আমরা এখন আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আদালতের পরবর্তী নির্দেশনা পেলেই নিয়োগের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।