চামড়া খাতে ব্যাংক ঋণ, তিন হাজার কোটি টাকার হদিস নেই

ব্যাংক থেকে টাকা নিলে আর ফেরত দিতে হয় না। এটা ব্যাংকিং নিয়ম নয়। কিন্তু বছরের পর বছর এমনটিই হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে। বিশেষ করে চামড়া খাতে নেওয়া ঋণের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। চামড়া খাতের ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক থেকে চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এ খাতে তাদের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৭০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত রয়েছে। তবে নিয়মিত ঋণের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ আদায় হচ্ছে। অবশিষ্ট টাকা বকেয়া থাকার পর সেগুলোও খেলাপি হয়ে পড়ছে।

ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, আগে চামড়া কেনার কথা বলে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা ফেরত দিতেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলো বর্তমানে এই ঋণ দেওয়ার আগে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আগের ঋণের কিস্তি বাকি থাকলে সেই গ্রাহককে নতুন করে ঋণ দেওয়া হয় না। যে কারণে এখন আর শত শত আবেদনও আসে না।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘চামড়া খাতে মূলত নব্বইয়ের দশকে নেওয়া ঋণ খেলাপি হয়েছে। বর্তমানে এ খাতে নেওয়া ঋণ খেলাপি হচ্ছে না। দুই-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই টাকা ফেরত দিচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোও তাদেরকেই ঋণ দিচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কাচা চামড়া কেনার জন্য বর্তমানে ৭১টি প্রতিষ্ঠান ঋণ পাচ্ছে। এই ৭১টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা একহাজার ১৩৭ কোটি টাকা। ১৮টি ব্যাংক এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ওই ঋণ দেয়। এর মধ্যে অনিয়মিত ঋণের পরিমাণ ৮৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘এখন যারা ঋণ পাচ্ছে, তারা প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ী।’ নতুন করে চামড়া খাতে খুব বেশি খেলাপি হচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি। শাহীন আহমেদ উল্লেখ করেন, নব্বইয়ের দশকে নেওয়া ঋণ খেলাপি হয়েছে। ১৯৯০ সালে সরকার হঠাৎ করে ‘ওয়েট ব্লু’ চামড়া রফতানি বন্ধ করে দেয়। ওই সময়ে ২৫ থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিনিশড চামড়া রফতানি করার সক্ষমতা ছিল না। ফলে তারা রুগ্ন হয়ে পড়ে। মূলত,এ কারণে তারা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি।

প্রসঙ্গত, চামড়া খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে উত্তরা, ন্যাশনাল, ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক কিছু ঋণ দিয়ে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক গত ছয় বছরে চামড়া খাতে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ঋণ গেছে নিয়মিত চামড়া খাতে। বাকি ৭৩৩ কোটি টাকা গেছে কোরবানির চামড়া ক্রয়ে। এসব ঋণ ১০টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৫৮৩ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চামড়া খাতে ঋণ বিতরণ করেছে ৭৯৩ কোটি টাকা। এছাড়া, পুরনো খেলাপি আছে ১৩৫ কোটি টাকা। গত বছর তিনটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানকে মন্দের ভালো বিবেচনায় নিয়ে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, জনতা ব্যাংক এপর্যন্ত চামড়া শিল্পে একহাজার ২১৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে বকেয়া রয়েছে প্রায় ৮১৬ কোটি টাকা। ২০টি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ নিয়েছে। এছাড়া, আরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর সুপারিশ করেছে। ইতোমধ্যে গ্রুপটির এক হাজার ৪১০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি দেখানো হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া খাতে ঋণ দিয়েছে ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ব্যাংকটি ২০১৩ সালে আট প্রতিষ্ঠানকে ৯০ কোটি ৮৯ লাখ, ২০১৪ সালে চার প্রতিষ্ঠানকে ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ও ২০১৫ সালে তিন প্রতিষ্ঠানকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এসব ঋণের বেশিরভাগই অনাদায়ী। আদায় পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ২০১৭ সালে এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেও শেষ পর্যন্ত কোনও ঋণ দেয়নি ব্যাংকটি।

প্রসঙ্গত, কাঁচা চামড়ার বড় সরবরাহ আসে মূলত কোরবানির ঈদে। ব্যবসায়ীরাও কোরবানির ঈদেই বেশি চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কয়েক লাখ মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া কেনেন। কয়েক হাজার পাইকারি ব্যবসায়ী এই চামড়া তাদের কাছ থেকে কিনে আড়তদারের কাছে জমা রাখেন। পরে এই চামড়া চলে যায় ট্যানারিতে।