সীমান্ত হত্যা শূন্যের দিকেই যাচ্ছে: বিজিবি প্রধান

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের ‍গুলিতে বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণায় অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি।

বাহিনীটির প্রধান মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সীমান্তে গুলিতে এক জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। আগের বছরও যা ছিল ২২ জন।

সোমবার সকালে পিলখানায় বিজিবির সদরদপ্তরে ব্রিফিং করেন বাহিনীটির মহাপরিচালক। এ সময় তিনি এসব কথা বলেন।

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যার বিষয়টি বরাবর আলোচিত বিষয়। ২০০১ সাল থেকে গত তিনটি সরকারের আমলেই সীমান্তে এক হাজার ৭৫ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। ওই সরকারের শাসনামলে পাঁচ বছরে এই সংখ্যাটি ছিল ৫৬৪। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ১১৩ জন করে বাংলাদেশি হত্যা হয়েছে।

এর মধ্যে ২০০১ সালে ৯৪ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৪ সালে ৭১ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন এবং ২০০৬ সালে ১৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দুই বছরে নিহত হয় আরও ১৮২ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬২ জন এবং ২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হয়। অর্থাৎ ওই আমলে প্রতি বছরে গড়ে প্রাণ হারিয়েছে ৯১ জন করে।

আর বর্তমান সরকারের আমলে ১০ বছরে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির তথ্য মিলেছে ৪০০ জন। অর্থাৎ বছরে ৪০ জন করে। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই সংখ্যাটি ধারাবাহিকভাবে কমছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৭ সালে সীমান্তে প্রাণ হারায় ২২ জন বাংলাদেশি। ২০১৬ সালে প্রাণ হারায় আরও ৩১ জন। ২০১৫ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৪৫ আর আগের বছর ৩৩।

আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর হিসাবে, ২০১৩ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯ জন। ২০১২ সালে ৩৮ জন আর ২০১১ সালে ৩১ জন। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৪ জন, আর ২০০৯ সালে ৯৬ জন।

বর্তমান সরকারের আমলেই দুই দেশের সরকার এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী এই বিষয়টি উদ্যোগী হয় আর এই হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণাও দেয়া হয় একাধিকবার।

চলতি বছর জুলাইয়ে রাজশাহী সীমান্তের কাছে গুলিতে নিহত তিন জনকে প্রথমে বাংলাদেশি ভাবা হলেও পরে জানা যায় তারা ভারতীয়।

গত ৩ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর বিজিবি-বিএসএফ সম্মেলনের কথা তুলে ধরে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘চলতি বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মাত্র এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এটি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সাথে সীমান্ত সম্মেলনে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’

নির্বাচনে বিজিবির ভূমিকা কী হবে?

আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে ভারত-মিয়ানমারের সহযোগিতা চাওয়ার কথাও জানান বিজিবি প্রধান। বলেন, ভোটের সময় রুটিন কাজ ছাড়া বাকি কার্যক্রম বন্ধ রাখবে বাহিনীটি।

ভোটে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও মোতায়েন থাকবে বিজিবি। এতে সীমান্তে তাদের সক্রিয়তায় কোনো ভাটা পরবে কি না- এমন প্রশ্ন ছিল মহাপরিচালকের কাছে।

জবাব আসে, ‘নির্বাচনকালীন সময়ে সীমান্তে বিজিবির সদস্য সংখ্যা কমে যাবে। এসময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী এবং মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সাথে কথা বলেছি। তারা ওই সময়টা তাদের সীমান্ত সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখবে।’

‘ওই সময় আমাদের প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকবে। একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ ছুটিতে থাকবে না। এগুলো নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করে ফেলেছি।’

নির্বাচনের আগে দেশে অস্ত্র চোরাচালান বাড়ে উল্লেখ করে বিজিবি প্রধান বলেন, ‘অস্ত্র চোরাচালানের বিষয়ে আমরা সচেতন রয়েছি। তিন মাস আগে থেকেই আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। আমরা বিএসএফ এর সাথেও কথা বলেছি; লোকবল, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।’

বিজিবি মহাপরিচালক জানান, চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত ৫৩টি পিস্তল, ১৬টি বন্দুক, ২৩৭ রাউন্ড গুলি, ৫০০ গ্রাম বিস্ফোরক, ১৭টি ডেটনেটর উদ্ধার করেছেন তারা।

‘অস্ত্র চোরাচালানরোধে সীমান্তে অতিরিক্ত নজরদারি করা হচ্ছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম ও কুমিল্লার দুটি স্থানকে ক্রাইম ফ্রি এলাকা হিসেবে ঘোষণার জন্য যাচাই-বাছাই চলছে।’

বিজিবি মহাপরিচালক জানান, বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্তে যৌথ টহল হয়েছে ১২ হাজারের বেশি। আর মিয়ানমারের সাথেও বাংলাদেশের যৌথ টহল হয়েছে দুই হাজারের বেশি।

গোপনাঙ্গে ইয়াবা পাচার

মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা পাচার রোধে বিজিবির চেষ্টার কথাও জানান বাহিনীর প্রধান। এ সময় তিনি পাচারকারীর নানা কৌশলের কথা জানিয়ে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।

সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক পাচারকারীরা নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এমনভাবে ইয়াবা পাচার করছে তা কল্পনাতীত। মহিলারা যদি নিজেদের গোপনাঙ্গে ইয়াবা নিয়ে আসে তাহলে সেটা কীভাবে ধরব?’

‘ডাবের মধ্যে ইয়াবা নিয়ে আসে, সবজির মধ্যে ইয়াবা নিয়ে আসে। তারপরেও আমরা ধরছি। না ধরলে এগুলো জানলাম কীভাবে?’

‘মিয়ানমার সীমান্তে তাদের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী মাদক পাচারের বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে। তারাও কাজ করছে। আমরাও কাজ করছি।’

দেশে মাদকের চাহিদা কমাতে পারলে চোরাচালান কমে আসবে বলে মনে করেন বিজিবি প্রধান। বলেন, ‘আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে চাহিদা কমানোর উপর। আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে আমরা দিন রাত কাজ করছি।’

চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত ৮২ লক্ষ ইয়াবা বড়ি, ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত দুই লাখ ৩২ হাজার ৮৬৭ বোতল ফেনসিডিল ইয়াবা জব্দ করার কথাও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

এই সময় মানব পাচারের সময় ৫৮১ জন ২০৮ নারী ও ১১৩টি শিশুকে উদ্ধার করার কথাও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।