১১৩ সিসি ক্যামেরার ‘বিশেষ কারাগারে’ আনিসুল-সালমানরা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আলোচিত রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-এমপি ও তাদের দোসর পুলিশ কর্মকর্তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) থেকে আলাদা করে ‘বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারে’ রাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১১৩ ক্লোজসার্কিট (সিসি) ক্যামেরার নজরদারিতে ওই কারাগার রয়েছে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে।

গত জুন মাসের শেষের দিকে দুই দফায় এবং জুলাইয়ের প্রথম দিকে তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুগত বন্দীদের ওই বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। এই পর্যন্ত ৪৮ জন রাজনৈতিক বন্দীকে সেখানে রাখা হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনের মামলায় এমন আরও দুইশ রাজনৈতিক বন্দীকে বিশেষ কারাগারে নেওয়া হবে। এই কারাগারটি পাঁচ বছর আগে তৈরি হলেও এতদিন ধরে সেখানে বন্দী রাখা হয়নি।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সেখানে যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) ছিলেন। ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন কারাগারে থাকা এমন বন্দীদেরও সেখানে নিয়ে রাখা হবে। পাশাপাশি কারাবিধি অনুযায়ী বিশেষ কারাগারে এসব বিশেষ বন্দীর পরিবারের সঙ্গে ১৫ দিনে একবার সাক্ষাতের ব্যবস্থা থাকবে। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, এই বন্দীদের মোবাইল ফোনে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ আছে বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।

কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বাউন্ডারি ঘিরে নারী বন্দীদের জন্য এই কারাগার তৈরি হয়। আনুমানিক পাঁচ বছর যাবত খালি পড়ে থাকা কারাগারটি এখন বিশেষ কারাগার হিসেবে ব্যবহার করছে কর্তৃপক্ষ। এই বিশেষ কারাগারে নতুন জেল সুপার, জেলার দায়িত্ব নিয়েছেন। এর পরপর তাদেরই উদ্যোগে সবকিছুর প্রস্তুতি শেষে রাজনৈতিক বন্দীদের স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু করা হয়।

কারা সূত্র জানা যায়, তিনশ বন্দী রাখার ধারণক্ষমতা রয়েছে এই বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারে। বর্তমানে এই বিশেষ কারাগারে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদিসহ মোট ৯৫ জন বন্দী আছেন। এদের মধ্যে ৪৮ জন বিশেষ বন্দী, অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী মন্ত্রী-এমপি ও তাদের দোসর কর্মকর্তারা। বাকিরা সশস্ত্র কারাদণ্ডে দণ্ডিত, যাদের কারাগারের ভেতরে কাজকর্মের জন্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই বিশেষ কারাগারে আরও দুইশ বিশেষ বন্দীকে রাখার কাজ চলমান।

বর্তমানে এই বিশেষ কারাগারে বিশেষ বন্দীদের একটি রুমে চারজন করে রাখা হচ্ছে। এই বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগার ১১৩ সিসি ক্যামেরা দ্বারা মনিটরিং করা হচ্ছে। কারা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পর্যাপ্ত নিরাপত্তার জন্য শিফটিং ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার জন্য ডিউটিতে থাকেন কারারক্ষীরা।

এ বিশেষ কারাগারে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রেপ্তার আলোচিত রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী-এমপি ও দোসর পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা রয়েছেন, তারা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

এই কারাগারে আরও আনা হয়েছে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, সাবেক দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সাবেক এমপি জাহিদ হাসান শামীম, সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, সাবেক এমপি মো. শহিদুজ্জামান সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও ডিএমপির ডিবির সাবেক কর্মকর্তা জাবেদ ইকবালকে।

তাদের দেখাশোনার জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদিদের বিশেষ কারাগারে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে- বন্দীদের সঙ্গে সতর্ক অবস্থায় কথা বলাসহ সব কাজ করা। বিশেষ কারাগারে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সবাইকে মনিটরিং করছেন ভেতরে পাহারায় থাকা কারারক্ষীরা।

এই বিশেষ কারাগারে বন্দীদের জন্য সরকারি আলাদা বরাদ্দ হয়েছে। বন্দীদের জন্য আলাদা রান্না করা হয়। বিনা প্রয়োজনে তাদের কক্ষে প্রবেশের সুযোগ নেই।

একটি সূত্র বলছে, পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের মন্ত্রী-কর্তারা খালি পড়ে থাকা এই নারী কারাগার ধোয়া-মোছার সময় বিরোধী দলকে দমনে ব্যবহারের ভয় দেখাতেন। অথচ সেই কারাগারেই আজ তারা বন্দী।

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) ঢাকা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স ও সদ্য প্রমোশন পাওয়া অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক) মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরানীগঞ্জ) পাশে সম্পূর্ণ আলাদা বিশেষ কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ বন্দীদের রাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পাশাপাশি বিশেষ বন্দীদের মনিটরিং কাজ খুব সূক্ষ্মভাবে করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, এটা যেহেতু বিশেষ কারাগার তাই বিশেষ বন্দীদের রাখার কার্যক্রম গত জুন মাসের শেষের দিকে শুরু হয়েছে। এখানকার নিরাপত্তা এবং অন্য বিষয়গুলোকে আধুনিক যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম সংবলিত করে তৈরির করা হয়েছে ও হচ্ছে, যাতে এটি মডেল কারাগার হিসেবে পরিচিতি পায়। আগামীতে এর আদলে যাতে অন্য কারাগারগুলোকে আমরা সাজাতে পারি, সেই চেষ্টা করা হবে।