যশোর সরকারি মহিলা কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগ

jessore map

যশোর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, দায়িত্বহীনতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। পতিত সরকারের দুই সমর্থকের সাথে আতাত করে যাচ্ছেতাই করছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, চলতি এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীনও তিনি সময় মতো কলেজে উপস্থিত না হয়ে তার ব্যক্তিগত পিয়ন আবু জারকে দিয়ে বাসা থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি সেন্টারে পাঠিয়ে দেন।

 

এই ফোনের এসএমএস অনুযায়ী ওই পিয়নের সহায়তায় প্রশ্নপত্র ওপেন করা হয়। যা পরীক্ষা আইনের চরম লংঘন। নিয়ম হচ্ছে অধ্যক্ষকে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে বোর্ড থেকে পাঠানো সেট কোড এসএমএসটি দেখে পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্র ওপেন করা। কিন্তু যশোর সরকারি মহিলা কলেজে সেই কাজটিই করছেন অধ্যক্ষের পিয়ন আবু জার। যা নিয়ে পরীক্ষা কমিটির সদস্যবৃন্দ চরমভাবে ক্ষুব্ধ।

সূত্র বলেছে, গত ৫টি পরীক্ষায় একইভাবে প্রশ্নপত্র পিয়নের মাধ্যমে ওপেন করা হয়েছে। কোন পরীক্ষার দিন অধ্যক্ষ সঠিক সময়ে কলেজে উপস্থিত হননি। এসব বিষয়ে কলেজের সাধারণ শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী ও ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরা চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
জানা গেছে, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি কখনো সরকারি এম এম কলেজ, কখনো সরকারি মহিলা কলেজে ইসলামী শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এ কারণে তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতি ও গ্রুপিংয়ে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সাবেক এমপি নাবিল গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এমপি নাবিল যে সময় যশোরে অবস্থান করতেন সে সময় প্রায় দিনই তিনি অফিস টাইম বা অফিস টাইমের বাইরে এমপি নাবিলের কাজী পাড়ার অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কাটিয়ে দিতেন। তিনি এমপি নাবিলের বহু রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বা সভা সমাবেশে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, একজন রাজনৈতিক নেতার মতোই বক্তৃতাবাজি করতেন।

২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর অধ্যক্ষ হিসেবে যশোর সরকারি মহিলা কলেজে যোগদান করেন। এর আগে ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে প্রথম দিকে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান অধ্যাপক নাজমুল হাসান ফারুক। কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতাকে ম্যানেজ করে তিনি ফের কর্মস্থলে সক্রিয় হন। এরপর থেকে অধ্যাপক নাজমুল হাসান ফারুক নিজেকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী হিসেবে পরিচিত করতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তার ফেসবুকের প্রোফাইলটি লাল করে পেছনের যত তথ্য উপাত্ত ডিলিট করে দেন। কিন্তু তার আগেই তার ফেসবুকের একাধিক পোস্ট তার প্রতিপক্ষরা স্ক্রিন শর্ট দিয়ে রেখে দেন।

সরকার পতনের তিন মাস আগে অধ্যাপক নাজমুল হাসান ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও কাউন্সিলর হাজি সুমনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন এবং তাদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করেন। যার ছবিসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় একাধিক খবর প্রকাশিত হয়। যা সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
অপরদিকে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিমের বিশ্বস্ত লোক হিসেবে পরিচিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বি এম নাহিদ নেওয়াজ সরকারি এম এম কলেজে চাকরিকালীন নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমপি আনারের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তিনি গোটা কলেজের পরিবেশকে অশান্ত করে তোলেন। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে সরকারের উপরি মহল থেকে তাকে অন্যত্র বদলী করা হলেও অদৃশ্য শক্তির জোরে তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যে যশোর সরকারি মহিলা কলেজে বদলী হয়ে আসেন। বর্তমানে এই ত্রিরতেœর কলেজে পরিণত হয়েছে যশোরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি মহিলা কলেজটি। অনেকে যশোর সরকারি মহিলা কলেজকে বর্তমানে মামা-ভাগ্নের কলেজ বলেও অভিহিত করছে।

এদিকে, গত এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য ৪ জন পরীক্ষার্থীকে নিয়ম বর্হিভূতভাবে মূল পর্বের ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অধ্যাপক নাহিদ নেওয়াজ, রফিকুল ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সূত্র বলছে, নির্বাচনী পরীক্ষার পরে একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সর্বোচ্চ তিন বিষয়ে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে মূল পর্বের পরীক্ষার ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হবে। এই তিন বিষয়ের অধিক সাবজেক্টে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে টিসি নিয়ে অন্য কোন কলেজে ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক বহু অকৃতকার্য শিক্ষার্থী সরকারি মহিলা কলেজ থেকে টিসি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে ৫/৬ সাবজেক্টে অকৃতকার্য শিক্ষার্থী সাথী খাতুন (রোল-১৩০৮৬), রিতু বালা (রোল-১১০০৮), ফারিয়া আফরিন লতিকা (রোল-১১২৭১) এবং সিযুথি দাস সুআরনাকে (রোল-১১০৯৮ কোন কারণ ছাড়াই পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সুযোগ প্রদান করেন। এ বিষয়ে কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকে নাহিদ নেওয়াজ থোড়ায় কেয়ার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক শিক্ষক।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক নাহিদ নেওয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, রেজাল্ট হওয়ার পরে আমরা একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পূর্ণ বিবেচনা করে উক্ত ৪ শিক্ষার্থীকে পুনরায় পরীক্ষা নিয়ে তারপর নতুন করে রেজাল্ট শিট তৈরি করে তাদেরকে পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে অধ্যক্ষের সাথে যোগযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ থাকার কারণে পরীক্ষার সময় ঠিকমতো কলেজে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। তাই মোবাইল ফোনটি পিয়ন আবু জারের মাধ্যমে কলেজে পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষা কমিটির মাধ্যমে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ওপেন করা হয়। সে সময় তার স্বশরীরে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ব্যক্তিগত অসুস্থতার কারণে তিনি থাকতে পারেননি বলে স্বীকার করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত আরো অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি মন্তব্য না করে বিষয়টি চেপে যাওয়ার অনুরোধ করেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ডক্টর আব্দুল মতিন গণমাধ্যমকে বলেন, অধ্যক্ষ হচ্ছেন পরীক্ষা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। প্রতিটি পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ১ ঘন্টা আগে অধ্যক্ষকে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বোর্ড থেকে প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত সেট কোডটি পাঠানো হয়।

সেই এসএমএস দেখে তিনি নিজে পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্রের সিলগালা করা খামটি ওপেন করে প্রশ্নপত্রটি পরীক্ষা কক্ষে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে যদি অধ্যক্ষ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শিক্ষা বোর্ড আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে কোন ছাড় দেওয়া হবে না।