তহুরা-মারিয়ারা যেন গোল মেশিন

এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব শুরু হওয়ার আগেই বাংলাদেশের কিশোরীদের লক্ষ্য ছিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে লাল-সবুজদের। বাছাই পর্বে খেলেছে চারটি ম্যাচ। আর চার ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ২৭ বার বল পাঠিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। শুধু তাই নয় চার ম্যাচে একটি গোল হজম করতে হয়নি মারিয়া-তহুরাদের।

মেয়েদের এই ফলাফল দেখলে মনে হতে পারে কোনো কঠিন দলের মুখোমুখি হতে হয়নি বাংলাদেশের। কিন্তু মনে হওয়া যত সহজ বাস্তবটা তা নয়। গত এক সপ্তাহ জুড়ে কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে মেয়েদের গোল উৎসবের পথ খুব একটা সহজ ছিলনা। কারণ লড়াই করেই জয়ের পাশাপাশি নিজেদের রক্ষণ সামলে রেখেছে মেয়েরা। যার জন্য কোনো গোল হজম ছাড়াই উঠেছে আসরের সেরা আটে।

এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের শুরুটা বাহরাইনকে দিয়ে। নিজেদের শুরুর দিনে অতিথিদের ১০ গোলে ভাসিয়ে দিল মারিয়া মান্ডার দল। দ্বিতীয় দিন প্রতিপক্ষ ছিল লেবানন। তাদের বিপক্ষেও গুনে গুনে দুই হালি। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের জালে সাত গোল দিয়ে।

কিন্তু নিজেদের শেষ ম্যাচে কষ্ট করতে হয়েছে বাংলাদেশের। এবারের বাছাইপর্বে বাংলাদেশের পাশাপাশি শক্তিশালী দল ছিল ভিয়েতনামও। কারণ পয়েন্ট ও গোল ব্যবধান সমান থাকায় দু’দলের সামনেই ছিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে ওঠার হাতছানি। যার জন্য শেষ ম্যাচটিকে বলা হয়েছিল অলিখিত ফাইনাল।

শেষ ম্যাচের শুরু থেকে নিজেদের রক্ষণ সামলে ছিল ভিয়েতনাম। একের পর এক আক্রমনে ভিয়েতনামের রক্ষণদূর্গকে তছনছ করে দিলেও গোলের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষায় থাকতে হয় ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে তহুরার গোলে স্বস্তি আসে বাংলাদেশ শিবিরে। আর দ্বিতীয়ার্ধে আঁখি খাতুনের গোলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য পূরণ হয় লাল-সবুজের মেয়েদের। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট কাটে বাংলাদেশ।

বাছাইপর্বের ২৯ দেশের মধ্যে সেরা আটে এখন বাংলাদেশ। গত মাসে থিম্পুতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৫ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের যে ভারতের কাছে ফাইনালে হেরেছিল বাংলাদেশ সেই ভারতও যেতে পারেনি শেষ আটে। শুধু ভারত নয় প্রথম পর্বের বাধা পেরোতে পারেনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য তিন দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দল হিসেবে বাংলাদেশের মেয়েরাই পেরেছে বাছাই পর্ব টপকে শেষ আটে যেতে।

প্রথমপর্ব টপকে যাওয়া বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, লাওস, চীন, ইরান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনকে নিয়ে হবে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রতিযোগিতা। সেখানে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলার পর চার দল উঠবে চূড়ান্তপর্বে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে আগামী বছর ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৩রা মার্চ।

দ্বিতীয় রাউন্ডে শেষ চারের সঙ্গে চূড়ান্তপর্বে সরাসরি খেলবে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ড। প্রতিযোগিতাটির মূল পর্বের আয়োজক হলো থাইল্যান্ড।

তবে টুর্নামেন্টে বাছাই পর্বের চ্যাম্পিয়ন হওয়া মারিয়াদের জন্য নতুন কিছু নয়। গেল আসরেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছিল বাংলাদেশ। তাই এবার তাদের চোখ থাইল্যান্ডের মূল পর্ব। চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে খেলতে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে বাংলাদেশের মেয়েরা। আর আত্মবিশ্বাসতো থাকবেই কারণ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন গত কয়েকবছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে এই দলটাকে গড়ে তুলেছেন। একের পর এক ম্যাচ জিতে সেই পরিশ্রমের প্রতিদানও দিচ্ছে মারিয়ারা।

এ নিয়ে গেল এক বছরে চারটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তিনটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। যার শুরুটা ছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় দিয়ে। তারপর চলতি বছরে হংকংয়ের জকি কাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ নারী দল। চার টুর্নামেন্টে শুধু হারতে হয়েছে দেড় মাস আগে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে। সেখানে পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে ফাইনাল মঞ্চে হার মেনে নিতে হয় তহুরাদের।

তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো চার আসরের মোট ১৫ ম্যাচে ৮৬টি গোল করেছে বাংলাদেশের কিশোরীরা। তার মধ্যে আরো অবাক করার বিষয় হল ৮৬টি গোলে বিপরীতে মাত্র তিনটি গোল হজম করেছে বাংলাদেশ।

যেভাবে ছুটে চলছে মেয়েদের জয়ের তরী সেটা যেকোনো প্রতিপক্ষের নিকটই থামানো কষ্টকর। সবমিলিয়ে হারিয়ে যাওয়া বাংলোদেশের ফুটবলে আবারও নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে মারিয়া-তহুরা-আঁখিদের হাত ধরে। এই প্রজন্মই হয়তো আবারও স্বপ্ন দেখাবে হাজারো ফুটবল প্রেমীদের চোখে।