শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ অবদান রাখায় যশোরের অভয়নগর উপজেলার মাগুরা গ্রামের শান্তিলতা ঘোষকে সংবর্ধনা জানাতে বৃহস্পতিবার যশোরে আসলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপুমনি। জিলা স্কুল অডিটরিয়ামে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যশোরের উদ্যোগে এ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী ডা: দিপু মনি বলেন, সর্বস্বত্যাগী শান্তিলতা ঘোষ। শিক্ষাবিস্তারের স্বার্থে তাঁর সমুদয় সম্পত্তি দান করেছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার মাগুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে। দিনহীন অবস্থায় বসবাস করলেও অশীতিপর এ শিক্ষানুরাগী নিয়মিত খোঁজ নেন তার বিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের, লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে কি-না। এ রকম এক মানুষ সম্মান জানাতে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। তিনি নিজে কিছু পাওয়ার জন্য দান করেননি। সমাজের উপকারের কথা ভেবে দান করেছেন। এখন এই সমাজের কিছু দায়িত্ব করেছে শান্তিলতার জন্য। আমাদের তা পালন করতে হবে। আমি মনে করি, এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তারা শান্তি লতার জন্য কিছু করবেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
বক্তব্য রাখেন- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: উত্তম কুমার বড়ুয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, মাগুরা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বাবু তারাপদ দাস, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির যশোরের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ, সাধারন সম্পাদক সাজেদ রহমান, অভয়নগরের প্রেমবাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রভাষক মফিজ উদ্দিন, যশোর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোলাম আযম প্রমুখ। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি শান্তিলতার হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে শান্তিলতাকে ক্রেস্ট, মানপত্র, শাড়ি দেয়া হয় এবং উত্তরীয় প্রদান করা হয়।
শ্রীমতি শান্তিলতা ঘোষ ১৯৩১ সালের ১২ ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামে। তার পিতা ইন্দুভূষণ বিশ্বাস ও মাতা সুমনা বিশ্বাস। তিন ভাই- বোনের মধ্যে শান্তিলতা ঘোষ প্রথম সন্তান। কিশোরী বয়সেই তিনি তার দুই ভাইকে হারান। পিতা ইন্দুভূষণ বিশ্বাস একজন সংস্কৃতিমনস্ক মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলেন। তিনি গ্রামে পালাগান, যাত্রাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। গ্রামে যে সমস্ত ছাত্ররা অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারতো না তাদের সাহায্য করতেন। এহেন সমাজসেবক সংস্কৃতিমনা শিক্ষানুরাগী ইন্দুভূষণ বিশ্বাস মাগুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নিঃশর্তে ৩৩ শতক ও বাজার স্থাপনের জন্য ৫০ শতক জমি দান করেন। শিক্ষামন্ত্রী অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের নামটি শান্তিলতার পিতা ইন্দুভুষনের নামে করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
শিশু শান্তিলতা গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শুরু করে কিন্তু ১৪ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হয়, যার ফলে আর বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না। যশোর কোতয়ালী থানার বসুন্দিয়া ইউনিয়নে জগন্নাথপুর গ্রামে বসবাসরত বিদ্যুৎ ঘোষের সাথে তার বিবাহ হয়। বিবাহের চার বছরের মাথায় তিনি একটি পুত্র সন্তানের জননী হন। কিন্তু জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই সন্তানের মৃত্যু হয়। বিয়ের ১০ বছর পর তার স্বামী কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
স্বাভাবিকভাবেই সন্তানহীন বিধবার প্রতি শ্বশুরবাড়ির লোকদের আচরণ রূঢ় থেকে রূঢ়তর হতে থাকে; একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন পিতার কাছে। তার কিছুদিন পর পিতা ইন্দুভূষণ মৃত্যুবরণ করেন।
অভিভাবকহীন হয়ে শান্তিলতা ঘোষ বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর ভর করে সংসার নির্বাহ করতে থাকেন। একাকিত্ব কাটানোর জন্য প্রতিবেশী সুনীল দে’র ২১ দিনের সন্তান গৌতম দে’কে দত্তক নেন। গৌতম তার ছেলে হিসেবেই বেড়ে উঠে। এরইমাঝে গ্রামের লোকজন এলাকার সন্তানদের লেখাপড়ার উন্নয়নের জন্য একটি মাধ্যামিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ গ্রহণ করেন। শান্তিলতার কাছে জমি চায়। পিতার আদর্শ অনুসরণ করে তিনি তার সমুদয় জমি (৬ দশমিক ৮৬ একর) মাগুরা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে লিখে দেন। তখন তার আবেদন ছিল স্কুলটি তার পিতা ইন্দুভূষণ বিশ্বাসের নামে করা হোক। কিন্তু স্থানীয় উদ্যোক্তারা গ্রামের নামেই স্কুলটি স্থাপন করেন।
সময়ের পরিক্রমায় তার পুত্র গেীতমকে বিবাহ দেন এবং তার সন্তান-সন্তানাদি হয়েছে। একটি জীর্ণ কুঠিরে তাদের কষ্টকর বসবাস। এ অবস্থার মাঝেও শান্তিলতা ঘোষ নিয়মিত ছুটে আসেন বিদ্যালয়ে; ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে কি-না সেই খোঁজখবর নিতে।
এরইমাঝে সকলের অগোচরে ২০১৭ সালে তার জীর্ণ মাটির ঘরে বাসা বাঁধে বিষধর সাপেরা। ভয়ে ঘরে থাকতে না পেরে তখন দেখা দেয় জীবনে বিষন্নতা। এ সংবাদে তৎকালিন অভয়নগর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনদীপ ঘরাই ছুটে আসেন সরজমিনে দেখতে। তখনই বোঝা যায়, শান্তিলতা ঘোষেরতো নিজস্ব কোনো জমি নেই; সবইতো দান করা বিদ্যালয়ের নামে। তাই ঘর সংস্কার করা বা নতুন করে স্থাপনের জায়গা কোথায়? তখন মনদীপ ঘরাইয়ের মধ্যস্থতায় স্কুল কর্তৃপক্ষ, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একমত হয়ে বিদ্যালয়ের নামে দান করা জমি থেকে ১ দশমিক ৪৯ শতক জমি গৃহনির্মাণের জন্য শান্তিলতাকে ফিরেয়ে দেয়া হয়। একইসাথে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে সরকারি অনুদানসহ উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তির সহায়তায় একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়।
শান্তিলতার ¯েœহময়ী ব্যবহারে তিনি এলাকার সকলের প্রদ্ধেয়া। কিছু না চাইলেও স্থানীয়রা তাকে কাপড়, খাদ্য ও চিকিৎসায় সহযোগিতা করেন। তিনি বয়স্কভাতা মাসিক মাত্র পাঁচশ’ টাকা সরকারি অনুদান পান। এই মহৎ হৃদয়ের মানুষটাকে দরিদ্রতার জন্য যেমন অভিযোগ নেই তেমনি তিনি সবসময়ই অন্যের কল্যাণ কামনায় ব্যস্ত থাকেন। জীবন সায়াহ্নে এসে শান্তিলতা ঘোষের একমাত্র চাওয়া পিতা ইন্দুভূষণ বিশ্বাসের নামে অন্তত বিদ্যালয়ের একটা ভবন করা হোক।