ফায়ার ফাইটারদের নিরাপত্তা কে দেবে?

‘আগুনের ঘটনায় যেকোনো সময় দেয়াল ধসে পড়তে পারে, আগুনে পুড়ে মারা যেতে পারি- এমন ঝুঁকি সব সময়ই থাকে। এরপরও ফায়ার ফাইটাররা অগ্নিঝুঁকি নেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অপারেশনে যান। আমরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি অথচ অনেক সময়ই ফাইটারদের ওপর হামলা হয়, কাজে বাধা দেয়া হয়। তাহলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কে দেবে?’

ফায়ারম্যান সোহেল রানা মৃত্যুর পর সোমবার দুপুরে এ প্রশ্ন তোলেন ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ।

তিনি বলেন, আমাদের ফাইটাররা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যের জীবন রক্ষার্থে নিয়োজিত থাকেন। ফায়ার ফাইটাররা আগুনের ঘটনায় সবার আগে ঘটনাস্থলে যায় এবং আটকে থাকা সবাইকে উদ্ধারের পরই বের হন। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে তার প্রমাণ দিলেন সোহেল রানা।

তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনায় সোহেল রানার পায়ের হার ভেঙে যায়। তার পেটে চাপ লাগে। তার রক্তনালীতে কার্বো মনোক্সাইড ঢুকে যায়। সোহেলকে বেঁচে থাকার জন্যও ফাইট করতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের সবাইকে ছেড়ে সিঙ্গাপুর স্থানীয় সময় রাত ৪টা ১৭ মিনিটে সোহেল রানা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

মেজর শাকিল বলেন, ‘ফায়ার ফাইটিং ইজ দ্য জব অব অ্যাবসুলেটলি প্রফেশনাল পিওপল। আমাদের কাজের জন্য একটা পরিবেশ লাগে। সেই পরিবেশটা নিশ্চয় আমাদের দেবেন। সেখানে যেন বিশৃঙ্খলা না হয়। কারণ আমরা প্রচুর প্রেসার নিয়ে কাজ করি। সেসময় যদি কেউ আমাদের মারে, আমাদের যন্ত্রপাতি নষ্ট করে, কাজ করতে না দেয়, হেস্তনেস্ত করে। পরিচালক হিসেবে আমি বলব, আমার সহকর্মীদের মারবেন না, ডিস্টার্ব করবেন না। কারণ অপারেশনের সময় একেকটা সেকেন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়টা তো আমাদের কাছে গোল্ডেন আওয়ার, প্লাটিনাম আওয়ার।

‘অনুরোধ, সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন। আমাদের ট্রাফিক জ্যাম দেবেন না, ক্লাউড করবেন না পরিবেশ। তাহলে আমরা তাড়াতাড়ি স্পটে পৌঁছাতে পারব। আরও মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে পারব’- যোগ করেন শাকিল।

তিনি বলেন, আগুন মোকাবেলায় অনেক কিছু দরকার। সব পর্যায়ে ফায়ার সিকিউরিটি ও প্রস্তুতি থাকতে হবে। এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় আমাদের আধা ঘণ্টা পর জানানো হয়। আমাদের যেতে আরও ১০ মিনিট সময় লাগে। আমাদের পর্যাপ্ত ফায়ার ইকুইপমেন্ট রয়েছে। কোনো কিছু কমতি নেই। ফায়ার ইকুইপমেন্ট পর্যাপ্ত থাকার পরও কি যথাসময়ে যেতে পারলাম? পাবলিক প্রাইভেট কোলাবরেশন থাকতে হবে। যদি আমরা যথাসময়ে জানতে পারতাম, তাহলে এতো মানুষের প্রাণ যেতো না।

ফায়ার ফাইটার সোহলে রানার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে উল্লেখ করে, মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, সরকারি চাকরিতে কিছু নিয়ম নীতি আছে। পেশাগত সময় কেউ ঝুঁকির কারণে মারা গেলে ক্ষতিপূরণ দেবার একটা ফরমালিটিজ তো আছেই। সেই ফরমালিটিজগুলো অবশ্যই মানা হবে। কারণ সোহেল রানা জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

সোহেল রানার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা, অন্যের জীবন রক্ষার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আনন্দ আছে এসব ক্ষেত্রে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও। এক্ষেত্রে পুরো সফল সোহেল রানা। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আশা করছি, সোহেল রানার মৃত্যুতে আমাদের ফাইটাররা আরও সতর্কতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বোচ্চটুকু উজার করে দেবে ফাইটিংয়ে।

গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নিহত এবং ৭১ জন আহত হন। এদিন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা উঁচু ল্যাডার (মই) দিয়ে আগুন নেভানো ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করছিলেন। ভবনে আটকে পড়া ৪-৫ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে একসঙ্গে নিচে নামানোর সময় ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত ল্যাডার নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। ল্যাডারের ওজন কমাতে এক পর্যায়ে সোহেল নিজেই ল্যাডার বেয়ে নিচে নামছিলেন। ল্যাডারের ওজন কমায় সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এতে করে তার একটি পা ল্যাডারের ভেতরে ঢুকে যায়। এছাড়া তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচণ্ড চাপ লাগে।