মিনারুল হত্যার রহস্য উদঘাটন

jessore map

যশোর সদর উপজেলার সালতা গ্রামে কৃষক মিনারুল হত্যাকান্ডের রহস্য উঘাটন হয়েছে। পরকীয়া প্রেমের জের ধরে ওসমানপুর গ্রামের চাঁদ আলী মোল্লার ছেলে হাফিজুর রহমান দা দিয়ে কুপিয়ে মিনারুলকে হত্যা করে। হাফিজুর বেসরকারি সংস্থা জাগরনী সমিতির কৃষি বিভাগে কাজ করে। এঘটনায় ২৪ আগস্ট শনিবার দুপুরে হাফিজুরকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো আব ইনভেস্টিগেশনের তদন্তে এই রহস্য বেরিয়ে আসে। গত ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার পুলিশ হেডকোয়াটারের নির্দেশে মিনারুল হত্যামামলাটি তদন্তভার পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, নিহত মিনারুল দর্জির কাজ শেখার জন্য আসামি হাফিজুরদের বাড়িতে ছোট ভাই মান্নানের কাছে যেত। বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে হাফিজুরের প্রথম স্ত্রী সাবিনার সাথে মিনারুলের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উছে। সাবিনা ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কাটামানা পরানপোতা গ্রামের করিম বিশ্বাসের মেয়ে। ১৫ বছর আগে রাত ১১ টার দিকে সাবিনার সাথে অবৈধ মেলামেশার সময় মিনারুলকে দেখে ফেলে সাবিনার স্বামী হাফিজুর। ঘটনার জন্য মিনারুল হাফিজুরের কাছে ক্ষমা চায়। বিষয়টি হাফিজুর গোপন রাখে। অবৈধ সম্পর্কের কারণে সাবিনাকে তালাক দেয় হাফিজুর। পরবর্তীতে ডলি বেগমকে বিয়ে করে।
সাবিনার সাথে অবৈধ সম্পর্কের পর মিনারুল সালতা গ্রামের লিয়াকতের মেয়ে বিলকিসের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে। বিলকিস অন্তসত্তা হয়ে পড়ে। কিন্তু বিলকিসকে বিয়ে করেনি মিনারুল। বিলকিসের ঘটনায় মিনারুল জেল খেটে বের হলেও হাফিজুরের রাগ মেটে না। হাফিজুর মিনারুলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মিনারুলের সাথে বাইরে সম্পর্ক গড়ে তোলে। মিনারুলকে হাফিজুর মামা বলে ডাকে। মিনারুল ও হাফিজুর দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। সাবিনার সাথে অবৈধ সম্পর্কের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হাফিজুর।
১২ আগস্ট ঈদ উল-ফিতরের কয়েকদিন আগে হাফিজুর মিনারুলের বাড়ি যায়। স্ত্রী সাথির সাথে মিনারুলকে আমোদ ফুর্তি করতে দেখে হাফিজুরের রাগ হয়। হাফিজুর মনে মনে মিনারুলকে হত্যার সিদ্দান্ত নেয়। ঈদের পর দিন ১৩ আগস্ট রাত আনুমানিক ১ টার দিকে হাফিজুর মিনারুলের বাড়ি যায়। ওই সময় মিনারুল ঘুমিয়ে ছিল। মিনারুলকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। মিনারুল ও হাফিজুর বাড়ির পাশে আম গাছের নীচে বসে বিড়ি খায়। পরে ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১০ টার দিকে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে হাফিজুর আছাড়ি চাড়া একটি দা হাতে নিয়ে খালি গায়ে একটি গামছা নিয়ে মিনারুলের বাড়ির ২ শ গজ দুরে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। শরীরে যাতে রক্ত না লাগে এ জন্য খালি গায়ে মিনারুলের বাড়ি যায়। মিনারুলে সাথে কথা বলে। এসময় মিনারুলে স্ত্রী সাথি পাশে বসে মোবাইলে ভারতীয় সি আই ডি দেখছিল। মিনারুল গরুর জন্য বিচালি কাটছিল। মিনারুলের সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে হাফিজুর বাইরে চলে যায়। সুযোগ খুজতে থাকে হাফিজুর। মিনারুলে বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখে। মিনারুলের বাড়িতে প্রচীর নেই। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। মিনারুলের বিচালি কাটা শেষ হলে স্ত্রী সাথি ঘরে চলে যায়। দু আটি বিচালি বাড়ির সামনে বিচালি গাদায় রাখতে যায় মিনারুল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি মিনারুলকে বাইরে ডাকে হাফিজুর। কৌশলে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বলে জঙ্গলে একটি মেগনেট জাতীয় জিনিস আছে বের করে দেখ মামু। মিনারুল জঙ্গলে উপুড় হয়ে টর্চ লাইট জালিয়ে জিনিসটি (মেগনেটটি) খুজতে থাকে। সেই সময় আসামী হাফিজুর সুযোগ বুঝে পেছন থেকে দা বের করে মিনারুলের ঘাড়ে দা দিয়ে দুই টি কোপ দেয়। মিনারুল পেছনে ঘোরার চেষ্টা করলে হাফিজুর তার হাতে থাকা দা দিয়ে মিনারুলের কপালে দায়ের উল্টা পিঠ দিয়ে আঘাত করে। মিনারুল মাটিতে পড়ে গেলে সে দা হাতে বাড়ীতে চলে যায়। দা পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে লুকিয়ে রাখে। আসামী হাফিজুরের স্বীকারোক্তি মতে মিনারুলকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আলামত দা টি হাফিজুরের বসতঘরের বারান্দার চৌকির কাথার নিচ থেকে স্থানীয় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আসামীর নিজ হাতে বের করে দেয়।

উল্লেখ, ১৪ আগস্ট বুধবার রাত ১০টার দিকে বাড়ির বসত ঘর সংলগ্ন গরুর গোয়ালের সামনে বসে মিনারুল গরুর জন্যে বিচালি কাটছিলেন। দু’আটি বিচালি কাটার পর তিনি ক্লান্ত বোধ করেন। বাকি দু’আটি বিচালি পলের গাদায় রাখতে যান। পলের গাদা ও গোয়াল ঘরের দুরত্ব দু-তিন ফুটের মতো। পলের গাদায় বিচালি রাখতে যেয়ে তিনি নিখোঁজ হন। এসময় বাড়িতে তার স্ত্রী বিথী খাতুন ছিলেন। হঠাৎ কাজ করতে করতে স্বামী মিনারুলকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। স্বজনরাও তাকে খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে রাত পৌন ১২টার দিকে মিনারুলকে বাড়ি থেকে বেশ দূরে খালের পাড়ে ইসমাইলের বাগানের ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা মিনারুলকে উদ্ধার করে জেনারেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরন করা হয়। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্দুর রশিদ তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকান্ডের ঘটনায় মিনারুলের বড় ভাই আখতারুজ্জামান বাদি হয়ে ১৫ আগস্ট কোতয়ালি থানায় মামলা করেন। নম্বর-৪১। মামলায় আসামি অজ্ঞাত দেখানো হয়। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় ফুলবাড়ি ক্যাম্পের আই সি আব্দুল জলিল।

পুলিশ মিনারুল হত্যাকান্ডের ক্লু উদঘানের জন্য মিনারুলে স্ত্রী সাথি খাতুনসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়। এরা হচ্ছে সদর উপজেলার সালতা গ্রামের হাকিম মোল্লার ছেলে বাবর আলী একই গ্রামের জহুর আলীর ছেলে ফজলুর রহমান, আব্দুল গনি শেখের ছেলে আলাউদ্দিন শেখ ও নিহত কৃষক মিনারুলের স্ত্রী সাথি খাতুন।

এদের মধ্যে বাবর আলী ও ফজলুর রহমান ও আলাউদ্দিন শেখকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে থাকে নিহত কৃষক মিনারুলের স্ত্রী সাথি খাতুন। ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার পুলিশ হেডকোয়াটারের নির্দেশে মিনারুল হত্যামামলাটি তদন্তভার পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। এরপর পিবিআই মিনারুলের স্ত্রী সাথিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তদন্ত করে মিনারুল হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত দাসহ আসামি হাফিজুরকে আটক করে।