অকালে ঝরে যাওয়া থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের স্মরণে যশোরে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন

অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসায় ঘিরে দশ মাস দশ দিন পেটে লালন করে একটি সন্তানের জন্ম দেয় একজন মা। আকাশ সম স্বপ্ন থাকে মায়ের হৃদয়ে, যা প্রকাশ করবার ভাষা হয়ত থাকেনা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরে অসহ্য প্রসব বেদনা সহ্য করেও জন্ম দেয় তিনি তার সন্তানকে। ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের মুখের হাসি দেখে সব দুঃখ-কষ্টকে ভুলে গিয়ে নতুন আশায়, নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে সব মায়েরাই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

জন্মের পরেই শৈশবে পদার্পণ হয় একটি শিশুর। শৈশবে সকল শিশুরই একটি মধুর স্মৃতি থাকে। থাকে প্রকৃতির সাথে খেলা করার কথা। বাবা-মা, ছোট বড় ভাই-বোন আর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে স্বার্থহীন ভালোবাসা পাবার কথা। তেমনই উপভোগ্যে কাটছিলো জন্মের ৮ মাস বয়স পর্যন্ত মাছুরা নামের একটি ছোট্ট শিশুর জীবনে। হঠাৎ করেই ওর শরীরে দেখা মিললো না চাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ের মতো এক মারাত্মক ভয়ঙ্কর থালাসেমিয়া নামক রোগ। ধীরে ধীরে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসলো মাছুরার অতিসাধারণ দিনমজুর বাবা-মায়ের পরিবারে। ও’কে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রতিমাসে ১-২ ব্যাগ রক্ত এবং অনেক টাকার ঔষধ। যার সবটুকু ব্যবস্থা করার সাধ্য ছিল না মাছুরার পরিবারের।

নাড়িছেঁড়া ধন মাছুরার ৯ মাস বয়স থেকে সংগ্রাম শুরু হলো মায়ের। শুরু হলো রক্তের প্রয়োজনে ছুটে বেড়ানো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনসাধারণের দ্বারে দ্বারে। কি এক জীবন! এভাবেই রক্তের প্রয়োজনে ছুটে চলা মায়ের সাথে একটা সময় সাক্ষাৎ হয় স্বজন সংঘ’র প্রতিষ্ঠাতা সাধন কুমার দাস এর। কান্নাস্বরে বলছিলো রক্ত ব্যবস্থায় তার সকল প্রতিবন্ধকতাগুলির কথা। তখন মাছুরার আনুমানিক বয়স ১.৫ বছর। তখন থেকেই সাধন দাস এবং স্বজন সংঘ’র সদস্যরা নিয়মিত রক্ত দিয়ে আসছিলো মাছুরাকে। এছাড়াও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের তারা নিয়মিত রক্ত দিয়ে থাকে। ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি এক বিভীষিকাময় দিন এসেছিল মাছুরার পরিবারে। আর কখনো রক্তের জন্য হয়ত ও’র মা ঘুরবেনা মানুষের দ্বারে দ্বারে, আর যাবেনা বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাসে। চাইবেনা রক্ত। ১৪ ই জানুয়ারি ২০১৭ ইং শৈশবের সকল চাওয়া কে উপেক্ষা করে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে মাছুরা। যা দাগ কাটে সাধন দাস’র জীবনে।

মাছুরার ঐ অকাল মৃত্যুর শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে স্বজন সংঘ’র সাধন কুমার দাস শুরু করেছিলেন থ্যালাসেমিয়া সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। এরই ধারাবাহিকতায় থ্যলাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে গত ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ রেল রোডস্থ, স্বজন সংঘ’র কার্যালয়ে ‘চাই স্বপ্ন’কে জানতে, সচেতন সমাজ গড়তে…এই স্লোগানকে সামনে রেখে সমাজের বিভিন্ন সংকট আর সমস্যা সমাধানে সচেতন সমাজ গড়া এবং কর্মের মূল্যায়নে সকলের মূল্যবোধকে জাগ্রত ও বিকশিত করার লক্ষে স্বজন সংঘ’র অঙ্গসংগঠন ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ মহান বিজয় দিবসে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শপথ বাক্য পাঠ ও সচেতনতামূলক ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পইন এর মাধ্যমে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা সম্পন্ন হয়। যা স্বজন সংঘ’র প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বিভাগ-এর মাধ্যমে কাজ করে।

swojon newsএরই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে মাছুরাসহ অকালে ঝরে যাওয়া বাংলাদেশের সকল থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের স্মরণে স্বজন সংঘ’র অঙ্গসংগঠন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র উদ্যোগে যশোর কালেক্টরেট পার্কে প্রার্থনা, থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শপথ পাঠ ও সরাসরি মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইন ও জনসচেতনতামূলক ষোলো হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়।

এসময় শপথ বাক্য পাঠ করান স্বজন সংঘ’র সাধারণ সম্পাদক ও অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সাধন কুমার দাস, সহ-সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় কুমার নন্দী, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মাসুদ হুসাইন, দপ্তর সম্পাদক সঞ্জয় মন্ডল, সদস্য নাজিম হোসেন, ইয়াছির আরাফাত শুভসহ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’র স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ।