আতঙ্কিত অনেকেই

papia lig

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক পাপিয়ার সাথে প্রভাবশালী কথিপয় রাজনৈতিক নেতা, কয়েকটি সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ক্যাসিনোকান্ডের সাথে জড়িত একটি চক্রের যোগসাযশের তথ্য পেয়েছেন তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা।

অবৈধ আয়ের টাকায় আনন্দপূর্তি করতে পাপিয়াকে নিরাপদ মনে করতে তারা। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বড় সিন্ডিকেটও রয়েছে তার। গ্রেফতারের পর পাপিয়াসহ অন্যান্যরা আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। একটি সংস্থার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন একটি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমন ওরফে মতি সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কথিপয় রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সংস্থার প্রভাবশালী ও দুনীতিবাজ কর্মকর্তা, কিছু ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনোর সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এদের (পাপিয়া ও তার গ্রুপ) নিয়মিত মেহমান ছিলেন। তাদের দেয়া প্রাথমিক তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। কাউকে ফাঁসানো বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে কারো নাম প্রকাশ করছে কিনা সেটাও আমরা বিবেচনায় রাখছি বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। খবর দৈনিক ইনকিলাব।

তিনি আরো বলেন, অনেক প্রভাবশালীর সঙ্গে পাপিয়ার বিশেষ এবং ব্যবসায়ী সর্ম্পক ছিল। ইতিমধ্যে র‌্যাব পাপিয়ার ঢাকার বাসা, অফিস এবং নরসিংদীর বাড়ি থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করেছে।

একাধিক সূত্র বলছে, পাপিয়াকে নিয়ে কথিপয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ভিবিন্ন সংস্থার দুনীতিবাজ কর্মকর্তা ও সদ্য বিপুল টাকার মালিক হওয়া ব্যবসায়ীর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ, পাপিয়াকে কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারা বিভিন্ন কমিটিতে বড় পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং কারা পাপিয়ার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন এর সব তথ্য এখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। কীভাবে পাপিয়ার উত্থান হয়েছে সে বিষয়টি নিয়েও তদন্ত চলছে। তবে এরই মধ্যে পাপিয়া অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের নাম বলেছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, পাপিয়ার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তবে ওই ব্যাংকে কত টাকা রয়েছে তা এখন পর্যন্ত পাপিয়া মুখ খুলেননি।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, তিনি দেশে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংকক ছাড়া আর কোন দেশে অ্যাকাউন্ট আছে কী-না খতিয়ে দেখছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়াও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে তিনি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তার অপকর্মের দুই সহযোগী রাকিব ও সুমন সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে ভারত থেকে অস্ত্র দেশে নিয়ে আসতেন। এরপর তারা ঢাকায় অস্ত্র ডিলারদের কাছে পৌঁছে দিতেন। সুমন ও রাকিবকে খুঁজছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়াও পাপিয়ার অপকর্মের সহযোগী সুমন কক্সবাজার থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট ঢাকায় নিয়ে আসতেন। সরবরাহ করতে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে। এছাড়াও ওই ইয়াবা ট্যাবলেট ওয়েস্টিন হোটেলসহ পাঁচ তারকার হোটেলে সরবরাহ করা হতো।

পাঁচ তারকা হোটেলে এতো টাকা ঋণ হওয়ার পরও কীভাবে তিনি সেখানে অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারলেন এ ব্যাপারে মুখ খুলেছে পাপিয়া।
তিনি তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, তার অস্ত্র ও ইয়াবার ব্যবসায় হোটেলটির একাধিক কর্মচারী জড়িত। তারা ওই টাকা পরিষোদের ব্যাপারে যাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ বেশী চাপাচাপি না করে সেই ব্যাপারটি তারা ব্যবস্থা করেছে। ওয়েস্টিন হোটেলের একাধিক কর্মচারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছে বলে জানা গেছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের আটক করা হতে পারে। পাপিয়ার মামলাটি র‌্যাবের পাশপাশি ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশও ছায়া তদন্ত শুরু করেছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাপিয়া বিমানবন্দর থানায় ছিল বলে জানা গেছে। তাকে রাতে শেরে বাংলানগরে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছিল বলে থানার ওসি সূত্রে জানা গেছে।

গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ টাকার জাল মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। জাল টাকা, অস্ত্র, মাদকের মামলায় পাপিয়া শেরে বাংলানগর ও বিমানবন্দর থানার ১৫ দিনের রিমান্ডে আছে। বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক কায়কোবাদ কাজী জানান, পাপিয়া রিমান্ডে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তবে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, পাপিয়া র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তার থাইল্যান্ডের ব্যাংককের একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলেও স্বীকার করেছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। তিনি আরও বলেন, মাদক ও অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সে অর্থ আয় করেছে। আমরা তার তথ্যের সূত্র ধরে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

র‌্যাব-১ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সূত্রে জানা গেছে, পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করে র‌্যাব ও পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনেক তথ্য অকপটে বলেছেন আর কিছু তথ্য ঢেকে রাখছেন। তবে তার বিস্তর অপকর্মের জানার জন্য তাকে জেরা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সূত্র জানায়, তাকে জেরার এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেছেন যে, প্রত্যেক তিন মাস মাস পর পর ব্যাংককে মাঝে মাঝে বন্ধু ও বান্ধবদের নিয়ে প্রমোধ ভ্রমণে যেতেন। তার সেটি ছিল প্রিয়স্থান। মিনি সেকেন্ড হোম। সেখানে হোটেল বিল যাতে বেশী না হয় ব্যাংকক শহরের অদুরে নোনতাবুড়ি এলাকায় পাপিয়া দুই রুম চুক্তি ভিত্তিক ভাড়া করেছিরেন। সেখানে তিনি দিনের পর দিন প্রমোধ ভ্রমণে থাকতেন।

সূত্র জানায়, আর্থিক লেনদেনকে সহজ করার জন্য ব্যাংককের একাধিক ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট আছে। ওই অ্যাকাউন্টে টাকাও রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কতটাকা সেখানে রয়েছে তা তিনি মুখ খুলেননি। তদন্তকারীদের ধারণা, তিনি ওই থাইল্যান্ডে টাকা পাচার করেছেন। ওই টাকা পরিমাণ জানা ও বিদেশ থেকে ফেরত আনার ব্যাপারে কাজ করছে তদন্তকারীরা।

সূত্র জানায়, পাপিয়ার অস্ত্র ব্যবসার সন্ধ্যান পেয়েছে তদন্তকারীরা। ঢাকার একাধিক অস্ত্রের ডিলারের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তিনি এবং তার সহযোগীরা অস্ত্র চোরাচালানের নতুন হাট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার পার্শ¦বর্তী দেশ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসতেন। পাশের দেশ থেকে রিভলভার, একে-২২ ও কাটা রাইফেল নিয়ে এসে ঢাকার ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করতে তার সহযোগীরা। পুরো বিষয়টি দেখভাল করতেন তিনি। অস্ত্র চোরাচালানে কেন তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন তার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তদন্তকারীদের তিনি জানিয়েছেন, সিলেটের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরেই তিনি ওই ব্যবসায় জড়িয়েছেন। ওই ব্যবসায়ীর নাম জানতে পেরেছে পুলিশ। পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তিনি গাঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

সূত্র জানায়, কক্সবাজার এলাকা থেকে ইয়াবারা বড় চালান ঢাকায় নিয়ে আসতেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি কুড়িয়ার সার্ভিসকে বেশী ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও মাদক সরবরাহে বড় পথ ছিল তার ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। ট্রেনে বেশী যাত্রী হওয়ার কারণে পুলিশ তেমন কাউকে সন্দেহ করতে না পারার কারণে তারা ট্রেনকে নিরাপদ ভেবে দিদারসে ইয়াবার কারবার চালিয়েছিল।

তদন্তকারীরা জানায়, এছাড়াও বিদেশী জাল টাকা তৈরি করা ছিল তার এক প্রকারের নেশা। একবার বসুন্ধরা শপিংমলে বিদেশী টাকা ভাঙ্গাতে গিয়ে তিনি জালনোটে ধরা পড়েছিলেন। সে যাত্রাই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পাপিয়া মুসলিম ধর্মের অনুসারী হলেও তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল কালী মন্দিরে। এর বাইরেও তিনি শিব লিঙ্গের পূজা করতেন। গ্রেফতারের পর দেখা যায়, পাপিয়ার এক হাতে কাবার ছবি, অন্য হাতে মন্দিরের ছবি আঁকা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজনীতিতে উত্থানের নিয়ামক হিসেবে দুজন প্রভাবশালী নেত্রীর নাম বলেছেন পাপিয়া। পরবর্তীতে তারাও নিয়মিতভাবে পাপিয়ার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। তাদের একজন তার ব্যবসায়িক পার্টনারও। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করতে পাপিয়ার সহায়তা চাইতেন অনেকে।

পাপিয়ার ককটেল পার্টি
রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোয় সুন্দরী তরুণী সরবরাহ করতেন শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। এসব হোটেলে প্রায়ই আসর জমাতেন তিনি। পাপিয়ার এই পার্টির একটা বিশেষ নামও ছিল। ‘ককটেল পার্টি’ নামে ওই নাচগানার আসরে মউজ মাস্তিতে মেতে ওঠতেন বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলা, প্রশাসনের বড় বড় ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদেরা। ওই অশ্লীল নাচ-গানের ভিডিও করে রাখা হত সুকৌশলে। পরবর্তীতে ওই ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা হত প্রভাবশালীদের। এভাবে তাদের কাছ থেকে বড় বড় কাজ বাগিয়ে আনতেন পাপিয়া।

পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর তার ব্যবহৃত মুঠোফোন ঘেটে বেশ কিছু ভিডিও পেয়েছে আইন-শৃংখলাবাহিনী। ওইসব ভিডিওর কোনো কোনোটি এরইমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। যা দেখে সবাই ধিক দিচ্ছেন মুখোশপড়া মানুষগুলোকে। এ নিয়ে দুদিন ধরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভিআইপিদের অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইল করে পাপিয়া অল্প সময়েই তিনি নরসিংদী ও ঢাকায় একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক বনে গেছেন। পাপিয়ার স্বামী সুমন স্ত্রীর ব্যবসায় সহযোগিতার পাশাপাশি থাইল্যান্ডে বারের ব্যবসা করেন।

অভিযোগ আছে, সরকার ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলোকে ব্যবহার করে দাপিয়ে বেড়াতেন এরা। দিনের পর দিন এমন অনৈতিক কাজ করে এলেও সবাই এদের ভয়ে তটস্ত থাকত।

রাজনীতির আড়ালে অপকর্মে পাপিয়াদের গুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সম্রাট আর পাপিয়া হলো গুঁটি। এমন অসংখ্য পাপিয়া আছে রাজনীতিতে। কিন্তু এদের যারা সৃষ্টি করেছে তাদের আমরা দেখি না। সেই গডফাদাররা সব সময় আড়ালে থেকে যায়। রাজনীতিতে দূষণ ছড়ানোর দায় এদের সবার। সরকার আন্তরিক হলে পেছনে থাকা ব্যক্তিদেরও মুখোশ উন্মোচন করবে বলে আশা করে সুজন সম্পাদক বলেন, তা না হলে এমন অভিযান মূল্যহীন হয়ে পড়বে।