রহস্যময় এক স্থান, নদীর পানি টকটকে লাল বরফের রং কালো!

বয়ে চলেছে নদী, পানির রং টকটকে লাল! নিশ্চয় ভাবছেন, পানির আবার কোনো রং হয় নাকি? সত্যিই রাশিয়ায় নরিলস্ক শহরে বয়ে চলেছে এক নদী, যার পানির রং টকটকে লাল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, সেখানকার বরফের রং কালো।

২০১৬ সালের বসন্তে নরিলস্ক শহরের বাসিন্দা পিটার লুনিয়েভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নদীর একটি ছবি শেয়ার করেছিলেন। যা দেখে অনেকেই চমকে উঠেছিলেন আবার ফটোশপ ছবি বলে অনেকেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ধুসর কালো প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী। যার পানির রং রক্তলাল। অনেকে ভেবেছিলেন ছবিটি ফোটোশপের কারসাজি। তবে শুধু পিটার লুনিয়েভই নন তার মতো অনেকেই নদীটির ছবি পোস্ট করতে শুরু করেন। তখন সারা বিশ্বে ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হওয়া শুরু হয়েছিল পিটার লুনিয়েভের ছবিগুলি।

এই রক্তলাল নদীর নাম ডাল্ডিক্যান। রাশিয়ার নরিলস্ক শহরেই রয়েছে নদীটি। এই শহরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিকেল উৎপাদনকারী কারখানা নরনিকেল। রাশিয়ার উত্তরে থাকা এই শহরটি সবসময় ধোঁয়াশা থাকে। দিনের ২৪ ঘন্টায় শহরের আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে।

সেখানকার বাতাসে সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই অক্সাইড ভেসে বেড়ায়। শহরের চারিদিকে আবর্জনার স্তুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শহরটি জুড়ে রয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ বছরের পুরোনো কল-কারখানা। সেসব কারখানাগুলোর অবস্থাও বেহাল। কারখানার আশেপাশে ছড়িয়ে আছে হাজারো রংচটা বাড়ি ঘর।

শহরটির আশপাশের খনি থেকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিকেল ও ক্যাডমিয়াম উৎপাদিত হয়। শহরের মাটিতে সবুজ নেই বললেই চলে। দূষণ এতই বেশি যে মেরুবৃত্তের কাছে থাকা শহরটিতে জমে থাকা বরফের রংও কালো। কালচে ধূসর মাটির ওপর ঝিমিয়ে থাকা শহরটিকে ওপর থেকে দেখলে মনে হবে পৃথিবী ওখানে থেমে আছে ১৯০০ সাল থেকে।

কেন নদীর পানি রক্তলাল?

খনি বিশেষজ্ঞ ডেভিড চেম্বার, ইন্টারনেটে নদীটির ছবি দেখেছিলেন। এরপর তিনি জানান, এই নদীর পানির রং লাল হওয়ার জন্য দায়ী, আশেপাশে থাকা খনি ও নিকেল উৎপাদনকারী কারখানাগুলো। সেখানকার বর্জ্যে মিশে থাকা অক্সিডাইজড আয়রন ডাল্ডিক্যান নদীতে মিশে পানির রং লাল করে দিচ্ছে।

এরকম অনেকবার হয়েছিল কানাডার সাডবেরিতে। স্থানীয় নিকেল ফ্যাক্টরিগুলো এভাবেই নিকটবর্তী নদীর পানিকে প্রায় এই রকম লাল করে দিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে তদন্ত কমিশন বসায় রাশিয়া সরকার। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিকেল নিষ্কাশন কারখানা নরনিকেল। মাত্র ৮৮০ ডলার আর্থিক দণ্ড দেয়া হয় কারখানাটিকে। এরপর সেখানকার ইঞ্জিনিয়াররা কারখানাটির বর্জ সুবিশাল পাইপের মাধ্যমে শহরের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

তারপরও নদীর পান লাল!

অবাক করা বিষয় হলো, বসন্ত এলেই ওই নদীর পানি আবারো রক্তলাল হয়ে যায়। ২০১৬ সালের পর ২০১৭, ২৯১৮, ২০১৯ সালেও নদীর পানি গ্রীষ্মে লাল হয়েছিল। এমনকি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও রক্তবর্ণ হয়ে যায় ডাল্ডিক্যান নদী। অথচ নদীতে এখন আর পড়ে না কারখানার বর্জ্য। তবুও কেন পানির রং লালচে? বিভিন্ন ভূবিজ্ঞানীদের ভিন্ন মতামত এক্ষেত্রে।

কেউ বলেছেন, উত্তর মেরুর কাছে থাকার জন্য নরিলস্ক শহরে প্রায় সারা বছর জুড়েই বরফ পড়ে। গ্রীষ্মের সময় বরফগলা পানি, প্রাচীন শহরে জমে থাকা বহু পুরোনো বর্জ্যগুলোকে ডাল্ডিক্যান নদীতে এনে ফেলে। তাই নদীর জল হয় রক্তলাল। আবার কেউ বলছেন, ডাল্ডিক্যান নদীটি থেকে কিছু দূরে একটি হ্রদ আছে। যার পানির রঙও লাল। কোনোভাবে সেই হ্রদের পানি এসে মিশছে নদীতে। যদিও হ্রদ ও নদীর মধ্যে কোনো সংযোগ নেই।

বাসিন্দাদের কী মত?

নরিলস্ক শহরের বাসিন্দাদের মত অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নৃশংস কিছু গণহত্যা দেখেছে এই শহর। বিভিন্ন কারখানার ভেতরে হাজারো মানুষকে মেরে, লাশগুলো ফেলে দেয়া হয়েছিল ডাল্ডিক্যান নদীতে। তাই সৃষ্টিকর্তার অভিশাপে নদীর পানি এমন লাল হয়ে যায়।

এই রহস্যময় নদীর বিষয়ে সেখানকার প্রবীণরা বলেছেন, এ ঘটনা আজকের নয়, শত শত বছরের পুরনো। তাদের বাপ-দাদা, এমনকি তাদেরও পূর্বপুরুষও এমন দৃশ্য দেখে গেছেন। মজার বিষয় হলো, তখন তো আর নরিলস্ক শহরে কোনো খনি বা কারখানা ছিল না। তাহলে তখন ডাল্ডিক্যানের নদীর পানি কেন বসন্তকালে রক্তলাল হতো? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বিজ্ঞানীরাও।