চীনে বেকার সমস্যা চরমে

চলমান নভেল করোনাভাইরাস মহামারীতে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে। দেশে দেশে বেকার সংকট চরমে। এমনকি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও কোটি কোটি মানুষ বেকার হিসেবে সরকারি সহায়তার আবেদন করেছেন।

ছোট, মাঝারি অর্থনীতির দেশের কথা বলাইবাহুল্য; এই সংকটের বাইরে নয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশ চীনও। দেশটির বিভিন্ন শহরে কাজ করা ২৯ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের বেশিরভাগই বেকার, তারা কোনো সরকারি সুবিধাও পাচ্ছেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও এবার চীনের চাকরির বাজার অধিকতর সংকটে।

জানুয়ারির শুরুর দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে যখন ‘নতুন ধরনের নিউমোনিয়া’ হানা দেয় তখন হঠাৎ করেই ঠান্ডা জ্বরে পড়েন গৃহকর্মী জু ল্যান। তখনো শহর কর্তৃপক্ষ নভেল করোনাভাইরাস নামের এ রোগটি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তবু নিয়োগকর্তা ল্যানকে বিশ্রাম নিতে বলেন। উহানের লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ল্যান এখন পর্যন্ত কাজে যোগ দিতে পারেননি।

‘সিঙ্গেল মাদার’ ল্যান ১০ বছর ধরে নানজিং শহরে কাজ করেন। তিন সন্তানকে নিয়ে এখন ভীষণ বিপদে। চার মাস ধরে কাজ খুঁজে পাননি। একাধিক জায়গায় আবেদন করেও ব্যর্থ হয়ে ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ৪১ বছর বয়সী এ নারীর কথায়, ‘আমার সাবেক নিয়োগকর্তা আমাকে ভালোই রেখেছিলেন। জানুয়ারিতে তিনি আমাকে বলছিলেন, যেন তার ফোনকলের অপেক্ষা করি। প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসার পর আমাকে ডাকার আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু মাসের পর মাস অপেক্ষা করে আমি এখন আশাই ছেড়ে দিয়েছি।’

চীনের ২৯ কোটি অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিকের মতোই ল্যানের বেকারত্বের বিষয়টিও সরকারিতে নথিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাই তিনি কোনো সরকারি সহায়তাও পাননি।

গত মাসে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে বলে ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেই তুলনায় চীনে বেকারের সংখ্যা কম, অবশ্য শুধু সরকারি নথির হিসাব এটি। একই মাসে চীনে ৬ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে বলে জানানো হয়, মার্চে যা ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

নভেল করোনাভাইরাস চীনের বিশাল অর্থনীতিকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ায় কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মার্চের শেষ দিকে বেকার ভাতা দেয়া পেয়েছে মাত্র ২৩ লাখ মানুষ।

চীনের বেকার সমস্যা কমিউনিস্ট পার্টির জন্যও এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ও সামাজিক অস্থিরতা প্রশমনে এ পার্টিকে এখন জু ল্যানের মতো কর্মহীন মানুষকে আর্থিক সাহায্য ও চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

সরকার অবশ্য বেকার সমস্যাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে শুরু হওয়া বার্ষিক ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে এবারই প্রথমবারের মতো জিডিপির কোনো লক্ষ্যস্থির করা হয়নি এবং সবাই কর্মহীন মানুষকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারটিতে জোর দেন। কিন্তু কংগ্রেসে জোর দেয়া হলেও চীনে বেকারত্বের প্রকৃত চিত্রটা আসলে সরকারি হিসাবের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম।

শ্যানডং-ভিত্তিক ঝংতাই সিকিউরিটিজ এপ্রিলের শেষ নাগাদ পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানায়, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা আসলে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ।

অভিবাসী শ্রমিকদের সহায়তাকারী বেইজিং-ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা সোস্যাল ওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ফর ফেসিলিটেটরস-এর প্রতিষ্ঠাতা লি তা মনে করেন, ২০০৩-০৪ সময়কার সার্স কিংবা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার চেয়েও কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে চীনের বেকারত্ব সংকট বেশি গুরুতর।

তিনি বলেন, ‘সার্স কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী ছিল না। তাছাড়া সে সময় অর্থনৈতিক সংকট কেবল রফতানি শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, অভ্যন্তরীণ সেবা খাতে অতটা খারাপ প্রভাব তখন পড়েনি।’

তার কথাটি মিথ্যা নয়। সার্সের প্রভাব চীনের অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মহামারীটি নিয়ন্ত্রেণে আসার পরপরই ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে চীনের অর্থনীতি উল্লম্ফন দেয়। আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে ২ কোটি ‘অভিবাসী’ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে, যারা মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করতো।

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে চীনের অভিবাসী শ্রমিকরা যে শুধু চাকরি হারিয়েছেন তাই নয়, তাদের বেতনের ওপরও কোপ পড়েছে। অধিকাংশ শ্রমিকেরই বেতন কর্তন করা হয়েছে। লি তা’র সংস্থা এক সমীক্ষায় দেখতে পেয়েছে, যেসব শ্রমিক এপ্রিল মাসে কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগেরই বেতন কর্তন করা হয়েছে।

৩৯ বছর বয়সী ওয়াং গুয়ান চাকরি ফিরে পেলেও তার বেতন কমেছে ৪০ শতাংশ। আগে ৪ হাজার ইউয়ান আয় করলেও এখন তা কমে নেমেছে ৩ হাজারে। প্রতি মাসে গ্রামে থাকা পরিবারকে ২ হাজার ইউয়ান পাঠান মাসিক খরচ হিসেবে। এখন তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। চাকরিটাই বা থাকবে তো? গুয়াং বলেন, ‘আমরা এখন এমন কাজগুলো করছি যা কিনা ভাইরাসের আগে পাওয়া। জানি না এসব অর্ডার শেষ হলে কী হবে।’

১৯৮০ সাল থেকে চীনের অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ও নগরায়নের পেছনে বিরাট অবদান রেখেছেন এই অভিবাসী শ্রমিকরা। শহর থেকে রেমিট্যান্স গ্রামে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পদের ব্যবধানও অনেকখানি ঘুচেছে এবং দারিদ্র্য কমেছে। দারিদ্র্য নিরসনই যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রধান লক্ষ্য!

লি তা বলেন, ‘যখন কোনো বিপর্যয় আসে তখন অভিবাসী কর্মীরা খরচ কমাতে গ্রামে চলে যান। পরিস্থিতি ভালো হলে তাদের ৮০ ভাগই শহরে ফিরে আসেন। কেননা গ্রামে কাজের তেমন সুযোগ নেই।’

সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট