রসায়নশাস্ত্রে নোবেল দুই বিজ্ঞানীর : ‘জীবন-নকশা’ সম্পাদনা উদ্ভাবনের স্বীকৃতি

জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ডিএনএ সম্পাদনার সূক্ষ্মতম কৌশল উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পেয়েছেন দুই বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন জার্মানির রসায়নবিদ ইমানুয়েল চার্পেনিয়ার ও যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার এ দোদনা। রয়াল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস গতকাল বুধবার এই পুরস্কারের জন্য তাঁদের নাম ঘোষণা করেছে।

জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই রসায়নবিদ সিআরআইএসপিআর/ক্যাস-৯ (CRISPR/Cas9) নামে জিন প্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য এমন একটি ধারালো কাঁচি বা টুলস আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে এর আগে লিখিত ‘জীবন-কোড’ আরো নির্ভুল ও সহজ করে পুনর্লিখন সম্ভব।

স্টকহোমের স্থানীয় সময় গতকাল বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে দ্য রয়াল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের স্থায়ী সেক্রেটারি জোরান হ্যানসন পুরস্কার ঘোষণার শুরুতেই বলেন, “এই বছর রসায়নের নোবেল পুরস্কারটি জীবন কোড সম্পর্কে পুনর্লিখনের বিষয়ে। দুজন রসায়নবিদ তাঁদের উদ্ভাবিত ‘ক্রিস্পার’ নামের অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও ধারালো একটি ‘জেনেটিক কাঁচি’ আবিষ্কারের জন্য এই পুরস্কার লাভ করেছেন, যা নির্ভুলভাবে জিনোম কেটে তা পেস্ট করতে সক্ষম হয়েছে। বৈপ্লবিক এই উদ্ভাবন বিশেষ করে নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণা কাজে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।”

মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে একটি স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজিনস। ইমানুয়েল চার্পেনিয়ার এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করার সময় ট্র্যাকআরআরএনএ নামের নতুন এক অণুর সন্ধান পান। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখেন, এই অণু ব্যাকটেরিয়ার প্রাচীন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ, যা আক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএ চিরে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ধরাশায়ী করে। এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই সিআরআইএসপিআর/ক্যাস-৯ নামে পরিচিত।

চার্পেনিয়ার তাঁর এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করেন ২০১১ সালে। একই বছর তিনি জেনিফার এ দোদনার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করেন। আরএনএ সম্পর্কে বিষদ জ্ঞানের অধিকারী অভিজ্ঞ প্রাণরসায়নবিদ দোদনার সঙ্গে তাঁর এ মেলবন্ধন প্রাণের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা দুজন ব্যাকটেরিয়ায় থাকা এই জেনেটিক কাঁচি টেস্ট টিউবে পুনরুৎপাদন করেন এবং ব্যবহারের সুবিধার জন্য এর আণবিক গঠনকে আরো সরলীকরণ করেন। পরে তাঁরা এই জেনেটিক কাঁচির ধরনে বদল আনেন।

প্রাকৃতিকভাবে ব্যাকটেরিয়ায় যে জেনেটিক কাঁচিটি থাকে, তা ভাইরাসের ডিএনএ চিনতে পারে। চার্পেনিয়ার ও দোদনা একে সম্পাদনা করে এমনভাবে বদলে দেন যা যেকোনো ডিএনএকে শনাক্ত করতে পারে এবং এর যেকোনো অংশে এটি কাঁচি চালানোর কাজটি করতে পারে। আর এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে বিজ্ঞানীদের হাতে। প্রাণ পুনর্লিখনের জন্য এই ডিএনএ কাটার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্ধারিত স্থানে ডিএনএ কাটার পর তাতে পুনর্লিখন করাটা সহজ।

২০১২ সালে এসে এই দুই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত জেনেটিক কাঁচিটি গবেষণার দুনিয়ায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত বহু নতুন ফসলের সন্ধান দিয়েছেন, যা খরা ও বন্যাকবলিত অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জরুরি। এমনকি কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এমন ফসলেরও সন্ধান পাওয়া গেছে এই প্রযুক্তির কল্যাণে। আর ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি বড় ধরনের অগ্রগতি এনে দিয়েছে।

ইমানুয়েল চার্পেনিয়ার ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সের জুভিসি-সুর-ওরেজে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি প্যারিসের ‘ইনস্টিটিউট পাস্তুর’ থেকে পিএইচডি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি জার্মানির বার্লিনে ম্যাক্স প্ল্যাংক ইউনিট ফর দ্য সায়েন্স অব প্যাথোজেনসের পরিচালক হিসেবে কর্মরত।

জেনিফার এ দোদনার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে, ১৯৬৪ সালে। বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল থেকে পিএইচডি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেকলিতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে রত। একই সঙ্গে তিনি হাওয়ার্ড হিউজ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে তদন্তকারী হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

আগামী ১০ ডিসেম্বর বিজয়ীদের সম্মাননা হিসেবে একটি করে স্বর্ণপদক, নোবেল মানপত্র ও ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে।

কভিড-১৯ মহামারির কারণে এ বছর ডিসেম্বরের ১০ তারিখে নোবেল বিজয়ীরা তাঁদের নিজ নিজ দেশের সুইডিশ দূতাবাস অথবা কর্মস্থল বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়েবিনারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘ভার্চুয়াল নোবেল পুরস্কার বিতরণ’ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। আর ২০২১ সালের নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে এই দুজনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আজ বৃহস্পতিবার সুইডেন সময় দুপুর ১টায় স্টকহোম থেকে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।