ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ভুলে মাসুল গুনছে বাংলাদেশি সাইফুল

দীর্ঘ ১৮ বছরের সংগ্রাম শেষে ক্লান্ত বাংলাদেশি নাগরিক সাইফুল ইসলাম। যুক্তরাজ্যে দেড় যুগের সংগ্রামী প্রবাসী জীবনে ব্রিটিশ হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) সঙ্গে তাঁকে লড়তে হয়েছে ১৮টি মামলা। তবু ন্যায়বিচার পাননি তিনি। ব্রিটেনের আপিল আদালত গত ৮ অক্টোবর এক রায়ে তাঁকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগও তাঁকে দেওয়া হয়নি। তাই সাইফুলের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

জানা গেছে, সাইফুল অপরাধ করেননি। অথচ অন্য অপরাধীর সঙ্গে সাইফুল ইসলামের কাগজপত্র গুলিয়ে ফেলে হোম অফিস। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় যৌন হয়রানির অভিযোগ। আটকে রাখা হয় পাসপোর্ট। কাগজপত্র ছাড়াই দীর্ঘ ১৭ বছর কাটিয়ে দেন সাইফুল। সেই হয়রানির শেষ হয় ২০১৯ সালে। হোম অফিস সাইফুলকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশে ফেরার।

মামলা লড়েন সাইফুল। সেখানে হোম অফিস তাদের ভুল স্বীকার করে নেয় এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ সর্বোচ্চ ছয় হাজার পাউন্ড দিতেও রাজি হয়। বিবিসি, আইটিভি, স্কাই নিউজ, গার্ডিয়ান, সানসহ মূল ধারার প্রায় সব ব্রিটিশ গণমাধ্যম সাইফুলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের খবর প্রকাশ করেছে। হোম অফিস তাদের সিদ্ধান্তে অনড় আছে।

পিটারবরার স্থানীয় এমপি পল ব্রিস্টো গত ৮ ডিসেম্বর সাইফুলের বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) প্রীতি প্যাটেলকে চিঠি লেখেন। সেখানে সাইফুলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে অমানবিক উল্লেখ করে তিনি বিষয়টি বিশেষভাবে যাচাই করারও অনুরোধ জানান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত আগস্ট মাসে যুক্তরাজ্যে সাইফুলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়টিকে অমানবিক হিসেবে উল্লেখ করেন। সে সময় তিনি আইনের মধ্যে থেকে সাইফুলের ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন।

ব্রিটেনের আইনজীবীদের সংগঠন ল সোসাইটির সভাপতি দেওয়ান মেহেদী সাংবাদিকদের জানান, তাঁদের সংগঠন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে। কিন্তু সাইফুলের ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাইফুলকে যদি সহায়তা করার কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে অবশ্যই তাঁদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।

লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সেক্রেটারি মোহাম্মদ জুবায়ের জানান, ‘গণমাধ্যম হিসেবে আমরা সাইফুলের পাশে ছিলাম, এখনো আছি এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই থাকব। আমরা চাই, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। মানবিক কারণে হলেও সাইফুলকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া উচিত।’

বাংলাদেশি সাইফুলের বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে শোরগোল থাকলেও সাইফুলের ভাষ্য অনুযায়ী, নীরব ভূমিকায় আছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আশিকুন নবী চৌধুরী জানান, সাইফুল ইসলামের আবেদনটি বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনকে অবহিত করার পরপরই হাইকমিশন তা যুক্তরাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেছে এবং এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া সাইফুল ইসলামের আবেদন যথাযথ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার জন্যও হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।

তিনি আরো জানান, যুক্তরাজ্যের অভিবাসনসংক্রান্ত আইন কিংবা সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারাধীন বিষয়ের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই।

সাইফুল বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিলেও কাজ করে খেতে পারব। এ দেশে থাকলেও কাজ করেই খেতে হবে। সেটা কোনো বিষয় না। ব্রিটেনের হোম অফিসের অবহেলা, ভুল, দীর্ঘসূত্রতার কারণে বহু বাংলাদেশির পরিবার, সংসার বিপর্যস্ত হয়েছে। মানুষ সীমাহীনভাবে ভুক্তভোগী। মানুষ হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।’

সাইফুল আরো বলেন, ‘এ লড়াই আমার একার না। হোম অফিস মানেই ব্রিটেনের অভিবাসীদের কাছে একটা আতঙ্কের নাম। সরকারের সেবাদাতা একটি প্রতিষ্ঠান কেন জনগণের জন্য আতঙ্কের কারণ হবে? আমি লড়াই করেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আদালতের সব নথি, চিঠিপত্র ও রায় প্রকাশ্যে আনার একমাত্র কারণ প্রতিবাদ করা।’