‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কী দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/ ‘কখন আসবে কবি’?/…শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ নাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/… কে রোধে তাহার বজ কণ্ঠের বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর -কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’-বরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ রক্তক্ষরা একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বহুল প্রতীক্ষিত শিহরণ-জাগানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক সংবলিত ঐতিহাসিক বজ কঠিন ভাষণের মুহূর্তটি এভাবেই তার কবিতায় তুলে ধরেছিলেন।
আজ রোববার, সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একটি দিন। ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর বঙ্গবন্ধুর যে ঐতিহাসিক ভাষণটি বাজানোর ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতার ডাক সংবলিত বজ কঠিন বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য অনেক গভীর। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ঐতিহাসিক এ ভাষণকে ‘বৈশ্বিক দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এ ভাষণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ’ দিবস হিসেবে ঘোষণা এবং দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক গত ১৫ অক্টোবর ২০২০ তারিখে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এ বছর থেকেই দিবসটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হচ্ছে।
তাই বাঙালি জাতি আজ কৃতজ্ঞ চিত্তে নানা আয়োজনের মধ্যে স্মরণ করবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সারাদেশেই এক আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করবে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর মধ্যে বিদ্যমান স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দিবসটি পালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণটির ৫০ বছর পূর্তিও আজ।
যেমন ছিল সেই দিন: আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে পুরো জাতি তখন স্বাধীনতার জন্য অধীর অপেক্ষায়। শুধু প্রয়োজন একটি ঘোষণার, একটি আহ্বানের। অবশেষে ৭ মার্চ এলো সেই ঘোষণা। ৭ মার্চের উত্তাল সেই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আসা মানুষের ভিড়ে সেদিন রেসকোর্স ময়দান রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।
সেদিন বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে উঠে দাঁড়ান মাইকের সামনে। আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু করেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ।
কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণের মতো তিনি বলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে তুলে আনেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়।
এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি। এ ভাষণই সংশয়ে থাকা বাঙালির চোখে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। এই ভাষণের পথ ধরে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চ‚ড়ান্ত বিজয়। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
অগ্নিঝরা একাত্তরের এইদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহতী কাব্যের স্রষ্টা কবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ গম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার চ‚ড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে।
আর এই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধে নয়, বঙ্গবন্ধুর সেই বজ নির্ঘোষ ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে। মূলত রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তি সংগ্রামের মূল ভিত্তি।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিপাগল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ থেকেই মূলত স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটতে থাকে এ বাংলায়। বাঙালির নিজের দেশের হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। আজ সেই ঐতিহাসিক দিন, ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি অনন্য সাধারণ দিন।
দেখতে দেখতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের বয়স ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিকৃতির নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের আবহে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার অনেক ইতিহাস। কিন্তু এই ৫০ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেলেও বদলানো যায়নি শুধু ১৯ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি। বিশ্বের অনেক মনীষী বা নেতার অমর কিছু ভাষণ আছে।
বিশ্বের মধ্যে এই একটি মাত্র ভাষণ যা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে- কিন্তু ভাষণটির আবেদন আজও এতটুকু কমেনি। বরং যখনই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঐতিহাসিক ভাষণটি শ্রবণ করেন, তখনই তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আন্দোলন-সংগ্রামের মুহূর্তগুলো, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের আদর্শে।
৫০ বছর ধরে একই আবেদন নিয়ে একটানা কোনো ভাষণ এভাবে শোনার নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। নানা গবেষণার পরেই মাত্র ১৯ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের ঢলে একাত্তরের এদিন রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে রীতিমতো জনবিস্ফোরণ ঘটে।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের মহামিলন হয়ে যায় তখনকার ঘোড়দৌড়ের এই বিশাল ময়দান। বিকাল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ক্ষমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স। রাজধানী ঢাকার চতুর্দিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক সামরিক জান্তারা রক্তচক্ষু নিয়ে প্রহরায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের যুদ্ধ জঙ্গি বিমান। মুক্তিপাগল বাঙালির সেদিকে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই। সবার শুধু অপেক্ষা তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু কখন আসবেন।
গণমানুষের স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান উঠে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশাল জনসমুদ্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাকামী জনতাকে আর বুলেট-বেয়নেটে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই বজ নির্ঘোষ কণ্ঠে রেসকোর্সের মাঠে তিনি আবৃত্তি করেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালির। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু সে।লাগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো…’।
সেদিন বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি প্রচারের কথা থাকলেও তা করতে দেননি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। কিন্তু মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশ, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষেরা কষ্ট না করে, সেজন্য যেসব অন্যান্য জিনিস আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।
রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে। …সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা- কোনো কিছুই চলবে না। …আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব…আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’
বেতারে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারের বাঙালি কর্মচারী তাৎক্ষণিক ধর্মঘট শুরু করে। ফলে বিকাল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দে র অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। তবে গভীর রাতে তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দেয়। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণ দিয়েই ঢাকা বেতার কেন্দ পুনরায় চালু হয়।
স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের তৃষ্ণা মিটল বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৯ মিনিটের অমর কবিতায়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা নেতা স্বাধীনতার ঘোষণাপূর্ব এ ধরনের ভাষণ দেয়ার নজির নেই। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার দিন থেকেই মূলত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটতে থাকে এ বাংলায়।
বাঙালির নিজের দেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। কেননা একাত্তরের ৭ মার্চ জাতির পিতার কণ্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা শোষিত-নির্যাতিত বাঙালি জাতিকে মুক্তির জন্য অস্থির-পাগল করে তুলেছিল। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড় থেকে মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষার উন্মতাল সেই তরঙ্গ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শ্যামল বাংলার আনাচে-কানাচে।
বঙ্গবন্ধুর অমোঘ মন্ত্রে দীক্ষিত-প্রাণিত হয়ে কঠিন সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে দেশ থেকে হানাদারমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। শুধু অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালি মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক সমরসজ্জিত, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মৃত্যুপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালি একাত্তরের মাত্র ৯ মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাস্ত-পর্যুদস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা।
ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, দুঃসাহসিকতা আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করল নিজস্ব মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা। এ কারণেই ৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় গৌরবের দিন।
বিশিষ্টজনের লেখায় ৭ মার্চ: জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘রণকৌশলের দিক থেকে এই ভাষণ অসাধারণ। এই বক্তৃতা এখনো মানুষকে শিহরিত করে। এই বক্তৃতার আগে রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে যে পাকিস্তানি সেনা শাসকরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাবে, সে বিষয়েও তিনি অবহিত ছিলেন। ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ গুটিকয়েক রাজাকার ছাড়া গোটা বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।’
