“আগষ্টের তৃতীয় সপ্তাহে নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় অন্তত ১২ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের এই জেলা সমূহে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।” “উজানে ভারি বর্ষণ চলতে থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটছে।”
“অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে গতকাল শনিবার সকালে দেশের আটটি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ফরিদপুরে নিম্নাঞ্চলে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
পানি উন্নয়নবোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর অবস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রক্ষপুত্র-যমুনা- নদীর পানি বাড়ছে যা আগামী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।”
“টানা কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। সাতটি প্রধান নদ-নদীর পানি ১৮টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার ফলে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।
পানি ও ভাঙ্গন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নদী পাড়ের মানুষ। শুকনো খাবারও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বহু এলাকায়। বেড়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরিয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার নিম্নাঞ্চল পুরোপুরি পানির তলে। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি এক দিনেই বেড়েছে ৮ সেন্টিমিটার। যমুনার পানি বিপদসীমার ৩৩
সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত, দুধকুমার নদীর পানিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে।”- বর্ণিত প্রতিবেদনগুলো বন্যাকালীন সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র। প্রতিবছরই বন্যার ভৌগলিক বিস্তৃতি বাড়ছে। মূলত ভাটির দেশ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নদীবেষ্টিত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
শুধু বন্যাই নয় তাপমাত্রা আশংকা জনকহারে বৃদ্ধি পাওয়া, খরা, ঘুর্ণিঝড়সহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি এখন বাংলাদেশ। এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো অব্যাহতভাবে বিবৃতি প্রদান এবং কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়ে সতর্ক করে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস রেড ক্রিসন্ট সোসাইটিজের এই শীর্ষ কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বলেছেন, সত্যিকার অর্থেই এই বিশ্বে মানুষের জীবন রক্ষা করতে হলে অনেক বেশি স্থায়ী পদক্ষেপ ও বিনিয়োগ করতে হবে। আইএফআরসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৬০ সাল থেকে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের ঘটনা নিয়মিত হারে বাড়ছে।
গত দশকে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বজুড়ে ৪ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই দরিদ্র দেশের বাসিন্দা ছিলেন। প্রতিবেদন বলছে, প্রচন্ড দাবদাহ ও ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী।”
বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার চারদেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে অতি উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেই ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের মতো নানা দুর্যোগের প্রতিকূল প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাংলাদেশের শিশুদের ওপর।
এতে বলা হলো, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ তম। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এই সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন টির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ছাড়াও উচ্চঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরও তিনটি দেশ
আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তান।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া আদজেই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেন, “প্রথমবারের মতো দশিণ এশিয়ার লাখো শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ুদূষণও নদী ভাঙ্গনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং স্বাস্থ্য সেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনা মহামারী মিলে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংকট তৈরি করেছে।
জর্জ লারিয়া আদজেই মনে করেন, পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে পরিবর্তনশীল জলবায়ু এবং ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়া পরিবেশের প্রভাব থেকে শিশুদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।” “জলবায়ু সঙ্কট, কার্যত শিশু অধিকারের সঙ্কট”- শীর্ষক এ প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিসিআরআই) প্রবর্তন করেছে ইউনিসেফ।
এতে শিশুদের ঘূর্ণিঝড় ও দাবদাহের মতো জলবায়ু ও পরিবেশগত প্রভাবের মুখে পড়ার পাশাপাশি তাদের জরুরি পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে দেশগুলোকে ক্রমানুসারে স্থান দেয়া হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ দূষণের কারণে সারাবিশ্বের মোট শিশুর অর্ধেকের জীবন-জীবিকাই ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সারা বিশ্বে মোট শিশুর সংখ্যা ২২০ কোটি। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারাবিশ্বের মোট শিশুর অর্ধেকের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
তাপদাহ, বন্যা, সাইক্লোন, দুরারোগ্যব্যাধি, খরা আর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের প্রতিটা শিশুই ঝুঁকির মুখে পড়বে। কিন্তু বিশ্বের ৩৩টি দেশে থাকা অন্তত ১০০ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের খুব বেশি ভয়াবহতার শিকার হবে। এর মধ্যে ভারত, নাইজেরিয়া, ফিলিপিন্স ছাড়াও সাবসাহারা অঞ্চলের দেশগুলো রয়েছে।
এ বিষয়টি আজ প্রমাণিত সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দারিদ্র বাড়ছে, শিশুরা সুপেয় পাচ্ছে না, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, শিক্ষার পরিবেশ থাকছে না। কিন্তু শিশুরা যেন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা মোকাবিলা করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে নীতিনির্ধারকদেরই।
জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিবেদন মোতাবেক, জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে ১০টি দেশে, যে দেশগুলো সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরনের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের জন্য দায়ী। অথচ এসকল দেশগুলোর অন্তত ৯২ কোটি শিশু বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়বে।
৮২ কোটি শিশু তাপদাহের শিকার হবে, ৬০ কোটি শিশু ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগে ভুগবে। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ মশার উপদ্রব বাড়ছেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দূষণের পরিমাণ অনেক বাড়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শিশুদের ঝুঁকিও বাড়ছে।
তাদের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সুরক্ষা হুমকির মধ্যে রয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি, অপরিকল্পিত নগরায়নসহ নানাবিধ কারণে শিশুসহ তাদের পরিবারের মধ্যে হেপাটাইটিস-এ, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, চিকুনগনিয়া জ্বরসহ বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।
আইএফআরসির মহাসচিব জাগান শাপাগেইন এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এখন করোনা মহামারী চলছে, এটি আমাদের সবার সামনে আছে। করোনা আমাদের পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়দের আক্রান্ত করছে। আমরা এখন অনেক বড়সংকটের মুখোমুখি।’
একই সময় তিনি হুশিয়ার করে বলেন, “আইএফআরসি আশঙ্কা করছে জরবায়ু পরিবর্তন বিশ্ব ও মানুষের জীবনে আরও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান করোনার টিকা তৈরিতে আশার কথা শোনাচ্ছে। শিগগিরই কোভিট-১৯ ঠেকাতে এগুলোর ব্যবহার ও শুরু হতে পারে।
দুর্ভাগ্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো টিকা নেই।” জীবন-বিপর্যয়কারী বন্যা, নদী ও উপকূলীয় ভাঙ্গন, খরা, শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং শহরে অভিবাসনের পরিমাণ বেড়ে পাওয়ায় বিশ্বের আনুমানিক ১ কোটি ৯৪ লক্ষ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
পরিবর্তিত জলবায়ু শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সুস্থতা হ্রাস করাসহ শিশুদের উন্নত ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ৬০ কোটির বেশি শিশুর বসবাস এবং এই অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, আগুন ও খরায় এই অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি মানুষের জীবনে প্রতিবছর প্রভাব পড়ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
আইএফআরসির প্রতিবেদন মোতাবেক, শুধু গত বছরেই বিশ্বে ৩০৮টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটছে। এসবের ৭৭ শতাংশই জলবায়ু ও আবহাওয়া সংক্রান্ত। এসব দুর্যোগে অন্তত ২৪ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সঙ্কট থেকে সুরক্ষা দিতে শিশুদের জন্য মূল পরিষেবাগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতার পেছনে বিনিয়োগ বাড়ানো; গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো; শিশুদের জলবায়ু বিষয়ক শিক্ষা এবং পরিবেশ বান্ধব দক্ষতা শেখানো; কপ-২৬ সহ সব জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনা এবং সিদ্ধান্তে তরুণদের অর্ন্তভুক্ত করা; এবং কোভিট ১৯ মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া যাতে পরিবেশবান্ধব স্বল্প কার্বন নির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে সরকার, ব্যবসা খাত ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছে ইউনিসেফসহ সকল উন্নয়ন সহযোগিরা।
আশার কথা এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ২৩ বছর বয়সী তাসিন এ নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তরুণদের একটি সংগঠন নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে পরিবেশবাদী সংগঠন। বৃক্ষরোপন ছাড়াও প্লাষ্টিক দ্রব্য কুড়িয়ে রিসাইকেলকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন তাঁরা। পাকিস্তানে ১৪ বছর বয়সী জামাল প্লাষ্টিক দ্রব্য পরিস্কার করার কাজ করছেন। ভারতের ভরত দিব্বি দেশ জুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করছেন। এ উদ্যোগ ভবিষ্যত বিষয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। বিশ্বাস করতে শেখায় ‘আলো আসবেই’। -শারমিন আফরোজ