দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রগণ্য বাংলাদেশ

gurni jhor
ফাইল ছবি

প্রাকৃতিক বা মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগ-যুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ বাংলাদেশের মানুষের মনের জোর ও লড়াই করার শক্তি বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্যোগের সক্ষমতা বেড়েছে। বছরের পর বছর দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে টিকে আছে,

কোন কৌশলে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে, তা জানতে ও দেখতে বিশ্বের তাবৎ বড় বড় গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে আসছেন। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলা ও জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দৃষ্টান্ত। বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ।

দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যসূচি তৈরি করেছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুনসহ বিশ্ব নেতারা। এমন সুসময়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস।

দেশে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের প্রতিশ্রম্নতি, জোরদার করি দুর্যোগ প্রস্তুতি’। ভৌগোলিক অবস্থান এবং ব-দ্বীপ-প্রধান দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বজ্রপাত, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, নদীভাঙন ও ভূমিকম্প বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটনা। বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। যা এখন দৃশ্যমান। জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্টতই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে।

প্রতিনিয়ত লবণ পানি, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন বাংলাদেশের মানুষ। ‘৭০-এর পর দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। এখন সরকার দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এতে যে কোনো দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। একই মাত্রার আরেকটি ঘূর্ণিঝড় সিডর ২০০৭ সালে আঘাত হানে। এতে তিন হাজার ৪০৬ জন নিহত হয়। আর ২০২০ সালের ২০ মে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মাত্র ২৩ জনের প্রাণহানি হয়।

এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের অর্জন। এখন বন্যা বা প্রাকৃতিক ছোটখাটো আপদ-বিপদে মানুষ এনজিওর দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সারাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সামাজিক ক্লাবগুলোর সদস্যরা কাজ করছে।

সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর হমায়ুন কবীর বলেন, ১৯৭০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বন্যা ও সাইক্লোন মোকাবিলায় অনেক এগিয়ে গেলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় এখনো পুরোপরি সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি দেশ।

ঢাকা শহরের সুউচ্চ ভবনগুলো কতটা নিরাপদ তা কেউ জানে না। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোয় হাঁটুপানি জমে। নিমতলী কিংবা চুড়িহাট্টাই নয়, পুরান ঢাকার অলি-গলিতে কেমিক্যাল থেকে লাগা অসংখ্য অগ্নিকান্ডে পুড়েছে শত শত প্রাণ।

রানা পস্নাজা ট্র্যাজেডি, তাজরীন গার্মেন্টসের আগুন, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নগর কেন্দ্রিক দুর্যোগে অসহায়ত্বের চিত্র। ঢাকায় বিল্ডিং মেনে ভবন তৈরি করছেন না কেউ। অপরিবর্তিত পদ্ধতির গ্যাস লাইন, ঝুলন্ত তারে বিদু্যৎ সংযোগ,

ওয়াসার অপরিকল্পিত পানির লাইন ও সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা নগরের দুর্যোগ ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অবহেলায় মৃতু্য আর ক্ষতির খতিয়ান দীর্ঘ হচ্ছে। সব সংস্থার সমন্বয়ে ঘন ঘন মহড়া দিলে ভূমিকম্প বা অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আতিকুল হক জানান, জিপিআরএস পদ্ধতিসহ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্যোগের ক্ষতি কমাতে সরকারের নানা উদ্যোগ রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় জ্ঞানকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার দুর্যোগ বিষয়ে একাধিক আইন ও নীতিমালা তৈরি করেছে।

এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। দুর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচির মাধ্যমে ৬৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ নারী। ইউএনডির সহায়তায় ১৩ লাখ স্কাউটসকে দুর্যোগ বিষয়ে সচেতনামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ও সিডিএমপি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বড় বড় শহরগুলোয় আরও ৩৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।