২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার অন্তত ৮০ জন!

২০২১ সালে অন্তত ৮০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

এ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৫১ জন, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ৮ জন, কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে ৮১ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে আসক।

শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন মানুষ।

ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সমালোচনা করে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ‘ক্রসফায়ার’কেই উৎসাহিত করে,

যা প্রকৃতপক্ষে দেশের সংবিধান প্রদত্ত মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার হরণসহ আইনের আশ্রয়লাভসংক্রান্ত সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী।

ক্রসফায়ার/ বন্দুকযুদ্ধ/ গুলিবিনিময়ে নিহত:
আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ/গুলিবিনিময়ে নিহত হয়েছেন ৫১ জন।

হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু:
আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২১ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ৮ জন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে ৬ জন, হার্ট অ্যাটাকে ১ জন এবং গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে নিহত হন ১ জন।

অন্যদিকে এ বছর দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৮১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৯ জন এবং হাজতি ৫২ জন। ২৮ মে খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারে মিলন বিকাশ ত্রিপুরা নামে এক বন্দি মারা যান। তার মাথায় আঘাত ও গলায় গামছা পেঁচানোর দাগ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম:
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার গুমের বিষয়ে বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। অপরদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলছে, গুম-খুন নিয়ে তদন্ত করার ক্ষেত্রে তাদের আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আসকের তথ্যানুসন্ধানে শুম বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, গুমের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য;

বিশেষ করে র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হয় এবং এরপর সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৭ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১ জন।

সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার পরিস্থিতি:
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ছিল ২০২১ সাল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘি পূজামণ্ডপে ‘কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্ট দেয়ার পর উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী কুমিল্লার ওই মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুরসহ ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। কুমিল্লার ঘটনার পরপরই চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম,

বান্দরবান, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপ ও মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর ও দোকানপার্টে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মারধরের ঘটনা ঘটে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে পিটিয়ে হত্যা ও আরেকজনের লাশ উদ্ধারসহ দুইজন নিহত হন। এ ছাড়া কুমিল্লায় হামলার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের আহতদের মধ্যে একজন পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

কমিল্লার ঘটনার জের ধরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের ৫ জন এবং ফেনীতে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে ১ জন নিহত হয়েছেন।

১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ থানা এলাকার মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৫টি বসতঘর, ৩টি দোকান, ১টি মন্দির ও ২টি পূজামণ্ডপে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের পাশাপাশি চালানো হয় লুটপাট।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০৪টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮৪টি বাড়িঘর ও ৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩ জন নিহত হন এবং কমপক্ষে ৩০০ জন আহত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ও সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন আসক নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর খান।

সূত্র: বাংলা নিউজ।