বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি মন্দাবস্থার দিকে ধাবমান!

dollar

করোনা আর ইউরোপের প্রান্তে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চরমে। জ্বালানি তেল, পরিবহণ ব্যবস্থা ও সরবরাহ নেটওয়ার্কে চাপ সৃষ্টি হওয়ার কারণেই অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বেড়েছে দ্রব্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতি। এহেন পটভূমিতে পর্যবেক্ষকদের সিদ্ধান্ত আশঙ্কা হলো, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এক মন্দাবস্থার দিকে ধাবমান

বাঙালি চিরায়ত সমাজে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চিত্রটি সবাই চেনা। বাজার যখন আগুন, তখন বাড়ির মেয়েদের গায়েই তার আঁচ লাগে সবচেয়ে বেশি। কারণ দুর্দিনে সংসারের সকলের মুখে পুষ্টিকর খাবার জোগানোর সমস্ত দায় এসে বর্তায় ‘সুগৃহিণী’দের কাঁধে। বস্তুত, বাইরে পুরুষের মেজাজ আর বাড়িতে মেয়েদের সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, মার্চে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.২২ শতাংশ, যা ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৭ শতাংশ। তার আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে গ্রামের খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমি ৬২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

আর মার্চ মাসে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারিতে তা আবার বেড়েছে। যা মার্চেও অব্যাহত ছিল। তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ মানুষও জানেন যে, পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি তথ্য বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বাজারে গেলেই সেটা বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, আশার কথা হলো এই যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘অপেক্ষাকৃত কম খারাপ’ বলা যেতে পারে। তথ্যানুযায়ী, আমেরিকার ক্ষেত্রে ভোক্তার নিরিখে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ। ৪০ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ইউরো-নির্ভর দেশগুলোতে তা ৭.৫ শতাংশ।

এই সব অর্থনীতি সাধারণত দুই শতাংশেরও কম স্ফীতিতে অভ্যস্ত ছিল। ভারতে পেট্রোল, ডিজেল-সহ কিছু খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আর্তস্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করছে জনতা। তবে, ভারতে ভোক্তার নিরিখে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নীচেই থেকেছে।

অন্যদিকে, এ প্রসঙ্গে ‘ব্রিকস’ অর্থনীতির দেশগুলোর দেশগুলোর দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতিকে ২০১০ সাল থেকে ‘ব্রিকস’ নামেই অভিহিত করে হয়।

ইংরেজ অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল দাবি করেছিলেন, ঐ দেশগুলোই ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান পরিচালক শক্তিতে পরিণত হবে। কিন্তু বর্তমানে ব্রাজিলের মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কের ১১.৩ শতাংশ, রাশিয়ার ১৬.৭ শতাংশ। কেবল মাত্র চীনের মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা সংহত। ১.৫ শতাংশে তারা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলছে। এই পরিসংখ্যানগুলি ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ সূত্রে প্রাপ্ত।

অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত প্রবৃত্তিতে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে। তার বৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এর পরেই রয়েছে চীন। তার বৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ। তুলনায় আমেরিকা এবং ইউরো-নির্ভর অঞ্চলের দেশগুলোর বৃদ্ধিহার যথাক্রমে ৩ এবং ৩.৩ শতাংশ।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোর বৃদ্ধির হার ‘উন্নয়নশীল’ তকমাধারীদের চাইতে স্বাভাবিক ভাবেই শ্লথ। এ সব সরিয়ে রেখেও দেখা যায়, বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্রাজিল স্থবিরতা প্রাপ্ত।

আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১০.১ শতাংশ ধসের কারণে রাশিয়া ঘোরতর সঙ্কটে। তুলনায় জাপানে মুদ্রাস্ফীতির হার কম এবং বৃদ্ধির হারও ক্রমোন্নতির দিকে।

দৃশ্যত বৈশ্বিক সঙ্কটের পটভূমিতে বিশ্বের নানা দেশের মুদ্রাগুলো একটি শক্তিতে পরিগণিত হতে শুরু করেছে। গত এক বছরে আমেরিকান ডলারের নিরিখে ভারতীয় রূপির মূল্যমান হ্রাসের মাত্রা ছিল মাত্র ১.৪ শতাংশ।

চীনের ইউয়ানকে বাদ দিলে ডলারের নিরিখে যে মুদ্রাগুলোর মানোন্নয়ন ঘটেছে, সেগুলো মূলত খনিজ তেল রফতানিকারক দেশগুলোর মুদ্রা, যার মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকো।

খনিজ তেলের দাম বাড়তির দিকে থাকলে ভারতীয় টাকার মানও তেজি থাকবে। সর্বোপরি, আমেরিকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারের ভবিষ্যদ্বাণী ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই মনে হচ্ছে।

‘ইন্টারেস্ট ইল্ড কার্ভ’ (যে লেখচিত্র দ্বারা বন্ড বা ঋণপত্রগুলোর পরিমাণগত সমতা রয়েছে, কিন্তু তাদের পূর্ণতাপ্রাপ্তির দিনক্ষণ পৃথক বলে ইঙ্গিত করা হয়)-এর বিপরীত গতি (অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্তি না ঘটে ধীরে ধীরে নিম্নগামী হওয়া) থেকে বাজার পর্যবেক্ষকদের সিদ্ধান্ত এই যে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এক মন্দাবস্থার দিকে ধাবমান।

এমতাবস্থায় অর্থনীতিবিদদের সামনে প্রধানতম প্রশ্ন হল, আমেরিকান অর্থনীতির নিয়ন্তা শক্তি কি মন্দাকে আহ্বান না জানিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হারকে নির্ধারণে সমর্থ হবে?

যদি তেমন কিছু ঘটে তবে বিশ্বের অর্থনীতির সর্বত্রই তার প্রভাব পড়বে। যদি বিশ্ববাণিজ্যের গতিতে শ্লথতা দেখা দেয়, তাহলে সারা বিশ্বের রফতানি বাণিজ্যও তার দ্বারা আক্রান্ত হবে, যার কুপ্রভাব পড়বে পৃথিবীর নানা,দেশে।

এমনকি, যদি এসব কিছু থেকে সরে এসেও দেখা যায়, তা হলেও তুলনামূলক কিছু পরিসংখ্যান সুসংবাদ বহন করার চেয়ে বিশ্বের ক্ষেত্রে দুঃসংবাদ বয়ে আনছে। নানা দেশে ‘আর্থিক বৃদ্ধি’ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করেছে।

যদিও সামান্য কিছু দেশ মুদ্রাস্ফীতির খুব খারাপ দশাতেও একটি মানসম্পন্ন মাত্রা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে। দেশগুলোর মাসিক উৎপাদনের পরিসংখ্যান মোটামুটি ভাবে ঠিকই থেকেছে। তবে, বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে ব্যবসায় মন্দার ছবিও একই সঙ্গে উঠে আসছে। মোদ্দা কথায়, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার ছায়া অবশ্যই দৃশ্যমান।

বিশ্ব আর্থিক মন্দার সম্ভাব্য বিপদে এককভাবে কোনও দেশের সরকারের ভূমিকা খুবই সামান্য। সরকার তার আর্থিক নীতির প্রসারণ ঘটাতে পারে, মহামারির ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন বিচ্যুতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে এবং এই মুহূর্তে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট গোলযোগের মোকাবিলা করতে পারে। এ লক্ষ্যে, কোভিডের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।

চীন সেটা শক্ত হাতে করে চলেছে। চীনের সর্ববৃহৎ মহানগর এবং অর্থনতিক হৃৎপিণ্ড সাংহাইয়ের দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও এমন ক্ষেত্রে এ কথা ভাবা বৃথা যে, দেশের অর্থনীতিতে কোনও পতন লক্ষণীয় হয়ে উঠবে না এবং বিশ্বের অন্যত্রও তা দৃশ্যমান হবে না।

বিশেষত, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু পর থেকে বিশ্বের কোনও কোনও স্থানে আবারও কোভিড মহামারির তরঙ্গ নতুন করে দেখা দিচ্ছে। সম্ভবত এই তরঙ্গগুলো আরও প্রকট এবং প্রসারিত হয়ে দেখা দেবে।

সুতরাং পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে যতখানি উজ্জ্বল বলেই প্রচার করা হোক না কেন, তা নিয়ে উল্লসিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও আসেনি। মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা বহুমুখী সঙ্কট-দীর্ণ এক বিপন্ন বিশ্বেই বাস করছি।

বিপন্নতার সর্বশেষ নমুনা দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয়েছে। পাকিস্তানে ক্ষমতায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। দেশটির অর্থনীতির যে অবস্থা, তা সেখানকার রাজনীতির মতোই দোদুল্যমান। শ্রীলঙ্কায় চলছে চরম সঙ্কট আর ঋণের বোঝার চাপ।

সেদেশের অর্থনীতি নিয়ে সতর্কতা জানিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। বলেছে, সেখানে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। দেখা দেবে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি। ঝুঁকি আছে ঘাটতির।

আইএমএফ বলেছে, নাজুক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যত্র স্বল্পমেয়াদী ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদী বিপদ বৃদ্ধি পাবে।

দেশে দেশে সরকারের তরফে বিশেষ কোনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলবে। জ্বালানি তেল, পরিবহণ ব্যবস্থা ও সরবরাহ নেটওয়ার্কে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সবমিলিয়ে বিশ্বের নানা দেশে আর্থিক মন্দাভাব সৃষ্টি হওয়ার বিপদও ফুঁসছে।