ব্যাংক খাতের সংকট আরও বাড়তে পারে

bangladesh bank

আগের সব সুবিধা ছাপিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিলের নতুন নীতিমালায় টাকা ফেরত দিতে আরও ঢিলেমি করবেন খেলাপিরা। অর্থ ফেরতের সক্ষমতা থাকলেও ইচ্ছা করেই অনেকে ফেরত দেবেন না। এতে তারল্য সংকটে পড়ে নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে ব্যাংক। যদিও কাগজে-কলমে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কম দেখানো যাবে। এভাবে খেলাপি ঋণ চেপে রাখার ফলে ব্যাংক খাতে সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্নিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে আদায়ে কঠোর নীতি প্রয়োগের চেয়ে বারবারই কীভাবে কম দেখানো যায়, সে উপায় বের করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নীতিমালায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ঋণখেলাপিদের ঢালাওভাবে গণছাড় দেওয়া হয়েছে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের মেয়াদি ঋণ খেলাপি হলে চারবারে ২৯ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ডাউনপেমেন্ট তথা নগদ জমার হার কয়েক ভাগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার মাত্র ৩ শতাংশ জমার বিপরীতে নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে; আগে যেখানে ১৫ শতাংশ জমা দিতে হতো। এ নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরেও নানা সমালোচনা হচ্ছে। বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ আদায় নিয়ে চিন্তায় পড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর না দিয়ে লুকিয়ে ফেলার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপিদের আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে সমস্যায় পড়ে গেছে। তবে আমানত প্রবাহ ঠিক থাকায় এখনই হয়তো সেভাবে সংকট বোঝা যাচ্ছে না। কোনো কারণে আমানত না পেলে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে। ঋণখেলাপিদের বারবার এভাবে ছাড় দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, এমনিতেই একটি শ্রেণি ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয় না। আরেক শ্রেণি আছে, যারা ঋণ ফেরত না দেওয়ার নানা ছুতো খোঁজে। ব্যাংকগুলো চাপাচাপি করে কোনোমতে টাকা আদায় করে। নতুন নির্দেশনার ফলে খেলাপির সুযোগ বাড়ল। নিয়মিত ফেরত দেন এ রকম অনেকেই আর ব্যাংকের টাকা দিতে চাইবেন না। তাঁরা পুনর্গঠন করবেন, পুনঃতপশিল সুবিধা নেবেন, গ্রেস পিরিয়ড নেবেন এবং নতুন করে আরও ঋণ নেবেন। এভাবে বড় অঙ্কের টাকা আটকে দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলবেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এত শিথিলতা কখনও কাম্য নয়। ঋণ ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়তে পারে।

প্রসঙ্গত, ঋণখেলাপিদের ছাড় এবারই প্রথম নয়। করোনার কারণে ২০২০ সালে কেউ এক টাকা না দিলেও খেলাপি হননি। ২০২১ সালে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, ১৫ শতাংশ দিলেই তাঁকে খেলাপিমুক্ত রাখা হয়েছে। চলতি বছরও যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি হবেন না। ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। তখন ৫২ হাজার কোটি টাকা পুনঃতপশিল হয়। এর আগে ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুবিধায় ১১ প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন হয়। তার আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ডাউনপেমেন্টের শর্ত শিথিল ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনার আলোকে ২০১৪ সালে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০১২ সালে ঋণ পুনঃতপশিলের নীতিমালা জারির পর থেকে খেলাপিদের সুবিধার বিষয়টি সামনে আসে। ওই নীতিমালার আলোকে একটি খেলাপি ঋণ ১২ মাস, ২৪ মাস ও ৩৬ মাসের জন্য সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতপশিল করা যেত। এ ক্ষেত্রে প্রথমবার পুনঃতপশিলে ঋণস্থিতির ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ ও তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ জমা দেওয়ার বিধান ছিল। এরপর কেউ নতুন ঋণ নিতে চাইলে ১৫ শতাংশ কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট জমার বিধান ছিল। এর চেয়ে আরও অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে নতুন নীতিমালায়।

আর্থিক খাত বিশ্নেষক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায় শুধু ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হবেন তেমন নয়, এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হবে। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য আরও আড়াল হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের টাকা আটকে থাকবে। তখন ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির ওপর চাপ তৈরি হবে। নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাবে।
অবশ্য রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম এই নীতিমালাকে সময়োপযোগী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়ন করবে, উপদেশ দেবে এবং তদারকি করবে। পুনঃতপশিল করবে ব্যাংক। তিনি বলেন, কেউ খেলাপি হলে তাঁকে বেইল আউট দিতে হবে। তা না হলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা :অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ঋণখেলাপিদের বিশেষ এ ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এবং সহকারী মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ এমন দাবি করেন। সিরাজুল ইসলাম বলেন, কোনো পক্ষের চাপে নয়, বরং করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘ হওয়ায় সব পক্ষের সুবিধার জন্য এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে করে খেলাপি ঋণ কমবে। পুনঃতপশিলের বিষয়টি ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলেও বিভিন্ন পরিদর্শনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক খতিয়ে দেখবে। সেখানে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।