খরচ হয়নি ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা

প্রকল্প বাস্তবায়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ কখনই হয়নি। উন্নয়ন কার্যক্রমে ধীরগতি, করোনা মহামারিসহ ১০ কারণে গত ৬ অর্থবছরে ব্যয় হয়নি ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সদ্যসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ হয়নি সংশোধিত বরাদ্দের ১৫ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এ বছর মূল বরাদ্দ বিবেচনা করলে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। পুরো বছরে ৫০ শতাংশের নিচে রয়েছে ৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আরএডিপি বাস্তবায়ন। সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শিল্প মন্ত্রণালয় অর্থ খরচ করেছে ১১২ শতাংশ। আর সর্বনিু ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, জনতুষ্টির জন্য বাজেট সব সময়ই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে চিত্রটা অন্যরকম হয়। এক্ষেত্রে সরকার বোঝাতে চায় আমরা খরচ করতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারি না। এরকম ঘটনার জন্য কোনো জবাবদিহিও নেই। কেন অর্থ ব্যয় করা গেল না, এর জন্য কারা দায়ী, সেটি যদি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলে বছরের পর বছর একই ঘটনা ঘটত না। যেমন রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও একই চিত্র বিরাজ করছে। কিন্তু কোনো জবাবদিহি নেই। এরকম প্রক্ষেপণে ভুল হওয়ায় বাজেট থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

কথা হয় সাবেক আইএমএডি ও পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংশোধিত এডিপির পর কেন এত বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা যায় না, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কেননা এডিপি সংশোধন করাই হয় সর্বশেষ বাস্তবায়ন অবস্থা পর্যালোচনা করে। এ বিষয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। মন্ত্রণালয়গুলোর মাসিক এডিপি পর্যালোচনা সভাগুলো কার্যকর থাকলে এরকমটা হওয়ার কথা নয়। ওই সভাগুলো আরও বেশি কার্যকর করা দরকার। পাশাপাশি ২ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী একটি সফটওয়্যার উদ্বোধন করেছেন। ‘এএমএস’ নামের এই সফটওয়্যারে প্রকল্পের সবরকম তথ্য ও অগ্রগতি থাকবে। ফলে কেউ চাইলেই বেশি বরাদ্দ নিতে বা কম খরচ করতে পারবে না। একটা নজরদারিতে থাকবে। এরকম অব্যয়িত অর্থের অঙ্ক আগামী দিনে কমে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব অর্থ ব্যয় হয় না, সেগুলো পরবর্তীকালে একই মন্ত্রণালয়ের অন্য প্রকল্পে পুনঃউপযোজন করা হয়।

আইএমইডির মতে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার বেশ কিছু কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজ করছে। যেমন সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প তৈরিতেই দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব অন্যতম। এছাড়া যেনতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের সময়ক্ষেপণও দায়ী। পাশাপাশি রয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা ও ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি প্রভৃতি।

আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরের মোট এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) আকার ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতেই উচ্চাভিলাসী বরাদ্দ ধরা হলেও ৮ মাসের মাথায় এসে শুরু হয় কাটছাঁট প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসাবে ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ছেঁটে সংশোধিত এডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছর (জুলাই-জুন) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। ফলে ব্যয় করা যায়নি ১৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের আরএডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৩৭ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরএডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৩৯ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরএডিপির ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা থেকে ব্যয় হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরএডিপি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা, ব্যয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। অব্যয়িত থাকে ৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি, ব্যয় ১ লাখ ৭ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। অব্যয়িত থেকে যায় ১২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ৫০ শতাংশের নিচে আরএডিপি বাস্তবায়ন করেছে তিন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। এগুলো হলো-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আইন ও বিচার বিভাগ ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ৪৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।