বাদ পড়লেন বিদ্রোহী ৯ প্রশাসক কপাল পুড়ল আরও ১৯ জনের

A. Lig Logo

 

দলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহের শাস্তি পেয়েছেন ৯ জন জেলা পরিষদ প্রশাসক। তাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। এ ছাড়া বর্তমান প্রশাসকদের মধ্যে ১৯ জনের কপালও পুড়েছে। এবার তাঁরা দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। অর্থাৎ ২৮ জন জেলা প্রশাসককে দলীয় মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ।

গত শনিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বৈঠকে চুলচেরা বিশ্নেষণ করার পর ৬১টি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী ১৭ অক্টোবর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, বর্তমান প্রশাসকদের মধ্যে ২৯ জন এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। ৩১টি জেলায় এসেছে নতুন মুখ। দলের মনোনীত এই নেতারা জেলা পর্যায়ে সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সৎ। সবাই দলের জেলা পর্যায়ের প্রথম সারির নেতা।

বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকজন সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কয়েকজন নেতা এবার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিবেচনায় রাখা হয়নি। কেউই মনোনয়ন পাননি। আবার কয়েকটি জেলায় দলের মনোনয়ন পাওয়া চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন এলাকায় যোগাযোগ না থাকার অভিযোগ রয়েছে।

 

বিদ্রোহের শাস্তি পেলেন ৯ প্রশাস

বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলের মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে আওয়ামী লীগের। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ৯ জন জেলা পরিষদ প্রশাসককে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাঁরা গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয় পেয়েছিলেন। দলের মনোনয়নবঞ্চিত এই প্রশাসকরা হচ্ছেন- রাজশাহীর মোহাম্মদ আলী সরকার, মেহেরপুরের গোলাম রসুল, চুয়াডাঙ্গার শেখ শামসুল আবেদীন খোকন, নড়াইলের অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন বিশ্বাস, পিরোজপুরের মহিউদ্দিন মহারাজ, জামালপুরের ফারুক আহমেদ চৌধুরী, শেরপুরের হুমায়ন কবির রুমান,

সুনামগঞ্জের নুরুল হুদা মুকুট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সফিকুল আলম।

 

একমাত্র ব্যতিক্রম

 

গত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় ৯ জন জেলা পরিষদ প্রশাসক এবার দলের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন সাতক্ষীরার নজরুল ইসলাম। এবার তাঁকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। নজরুল ইসলাম গত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মনসুর আহমেদের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিলেন।

 

কপাল পুড়ল ১৯ জনের

 

বর্তমান প্রশাসকদের মধ্যে ১৯ জনের কপাল পুড়েছে। তাঁরা দলের মনোনয়ন চাইলেও বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিত এই প্রশাসকরা হচ্ছেন- পঞ্চগড়ের আনোয়ার সাদাত সম্রাট, রংপুরের অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম, জয়পুরহাটের আরিফুর রহমান রকেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশরাফুল হক, পাবনার রেজাউল রহিম লাল, কুষ্টিয়ার রবিউল ইসলাম, বরগুনার দেলোয়ার হোসেন, বরিশালের মইদুল ইসলাম, ঝালকাঠির সরদার মোহাম্মদ শাহ আলম, নেত্রকোনার প্রশান্ত কুমার রায়, গাজীপুরের আকতারুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের আনোয়ার হোসেন, রাজবাড়ীর ফকীর আব্দুল জব্বার, ফরিদপুরের অ্যাডভোকেট শামসুল হক ভোলা মাস্টার, গোপালগঞ্জের চৌধুরী এমদাদুল হক, কুমিল্লার আবু তাহের, চাঁদপুরের ওচমান গনি পাটওয়ারী, নোয়াখালীর ডা. এবিএম জাফর উল্লাহ এবং চট্টগ্রামের আবদুস সালাম।

 

নতুন মুখের মিছিলে ৩১

 

৬১টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৩১টিতেই নতুন মুখ মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাঁদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানও রয়েছেন। নতুন মুখের সবাই দলের জেলা পর্যায়ের পরীক্ষিত নেতা। তাঁরা হচ্ছেন- পঞ্চগড়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবু তোয়বুর রহমান, রংপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ, গাইবান্ধায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, নীলফামারীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজুল হক, রাজশাহীতে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মীর ইকবাল, জয়পুরহাটে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাজা সামছুল আলম, চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রুহুল আমিন, পাবনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা আ স ম আব্দুর রহিম পাকন, মেহেরপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম, কুষ্টিয়ায় খোকসা উপজেলার চেয়ারম্যান সদর উদ্দিন খান, চুয়াডাঙ্গায় দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহফুজুর রহমান মঞ্জু, নড়াইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাস চন্দ্র বোস, বরগুনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, বরিশালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর, ঝালকাঠিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খান সাইফুল্লাহ পনির, পিরোজপুরে পৌরসভা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য সালমা রহমান, জামালপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট বাকী বিল্লাহ, শেরপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পাল, নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট অসিত সরকার সজল, গাজীপুরে কৃষক লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা, নারায়ণগঞ্জে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চন্দন শীল, রাজবাড়ীতে পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল মোরশেদ আরুজ, ফরিদপুরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম মেম্বার ফারুক হোসেন, গোপালগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুন্সী মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান, সিলেটে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, সুনামগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট খায়রুল কবির রোমেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার, কুমিল্লায় দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মফিজুর রহমান বাবলু, চাঁদপুরে চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ইউসুফ গাজী, নোয়াখালীতে নোয়াখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টু ও চট্টগ্রামে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এটিএম পেয়ারুল ইসলাম।

 

সৌভাগ্যবান ২৯

বর্তমান প্রশাসকদের মধ্যে ২৯ জন এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের কাছে তাঁরা সৌভাগ্যবান হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছেন। তাঁরা হচ্ছেন- ঠাকুরগাঁওয়ের সাদেক কুরাইশী, দিনাজপুরের আজিজুল ইমাম চৌধুরী, লালমনিরহাটের অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান, কুড়িগ্রামের জাফর আলী, বগুড়ার ডা. মকবুল হোসেন, নওগাঁর এ কে এম ফজলে রাব্বী বকু, নাটোরের অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খান, সিরাজগঞ্জের আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ঝিনাইদহের কনক কান্তি দাস, যশোরের সাইফুজ্জামান পিকুল, মাগুরার পংকজ কুমার কুণ্ডু, বাগেরহাটের শেখ কামরুজ্জামান টুকু, খুলনার শেখ হারুনুর রশীদ, পটুয়াখালীর খলিলুর রহমান মোহন, ভোলার আব্দুল মুমিন টুলু, ময়মনসিংহের অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান, টাঙ্গাইলের ফজলুর রহমান খান ফারুক, কিশোরগঞ্জের অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, মানিকগঞ্জের অ্যাডভোকেট গোলাম মহীউদ্দীন, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, ঢাকার মাহবুবুর রহমান, নরসিংদীর আবদুল মতিন ভূঁইয়া, মাদারীপুরের মুনির চৌধুরী, শরীয়তপুরের ছাবেদুর রহমান খোকা সিকদার, মৌলভীবাজারে মিছবাহুর রহমান, হবিগঞ্জের ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী, ফেনীর খায়রুল বশর মজুমদার তপন, লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ শাহজাহান এবং কক্সবাজারের মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী।

 

নতুন করে বিদ্রোহের গুঞ্জন

আওয়ামী লীগ মনোনীত ১০ প্রার্থী গত নির্বাচনে জয় পাননি। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় তাঁরা পরাজিত হন। সেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে ৯ জন এবার দলের মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সব জেলায় এবারও বিদ্রোহের গুঞ্জন রয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিত কয়েকজন প্রশাসকের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে দলের প্রভাবশালী নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 

অবশ্য কারা কারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর। ওই দিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। ১৭ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতিতে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রায় ৬৩ হাজারেরও বেশি জনপ্রতিনিধি ভোট দেবেন।

 

২০১১ সালের ডিসেম্বরে জেলা পরিষদ সচল হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরেই মন্ত্রী কিংবা এমপি হতে পারেননি আওয়ামী লীগের এমন সিনিয়র নেতারা জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁরা প্রায় পাঁচ বছর ওই দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচিত চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পায়।