কী হবে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির

সংকটের শেষ নেই জাতীয় পার্টির ভিতর-বাইরে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ জোটের ভিতরে থেকে না বাইরে থেকে করা হবে তা নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। দলের এমপিরা বিরোধী দলের নেতার পদ চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে চিঠি দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। এ বিষয়ে স্পিকার এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। এরশাদ পত্নী রওশনের পক্ষে এমপিদের মধ্যে শুধু রয়েছেন পুত্র সাদ এরশাদ। রওশনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। চিকিৎসার জন্য বেশিরভাগ সময় থাকতে হচ্ছে দেশ-বিদেশের হাসপাতালে। নেতা-কর্মীদের সমর্থন এখন জি এম কাদেরের পক্ষে। আগামী নির্বাচনে দলকে সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে কাজ করছেন জি এম কাদের। দলের ঐক্য ধরে রাখতেও তিনি তৎপর। অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ অবস্থান নিয়েছেন রওশন এরশাদকে নিয়ে আলাদাভাবে। সারা দেশে তাদের সুসংহত অবস্থা না থাকলেও কয়েকজন মিলে রেখা টানছেন বিভক্তির। এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দলীয় ঐক্য ধরে রেখে কাজ করছেন সিনিয়র নেতারা। বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থায় ঐক্য না থাকলে, অনেকের আশঙ্কা জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। জাতীয় রাজনীতিসহ যে কোনো বিষয়ের সমস্যার সমাধানের জন্য আন্তরিকতার কোনো বিকল্প নেই। আন্তরিকতার সঙ্গে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে নিশ্চয় একটি পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এই বিষয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। জাতীয় পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানান।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মৃত্যুর পর থেকে তার প্রতিষ্ঠা করা দল জাতীয় পার্টির কর্তৃত্ব ঘিরে স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জি এম কাদেরের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলতে থাকলেও এবার তা প্রকাশ্য। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল ডেকে কমিটি গঠন করেছেন। গত ৩০ আগস্ট রওশন এরশাদ গণমাধ্যমে এক বিজ্ঞপ্তিতে পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা বিষয় বর্ণনার পর দলের জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটিরও ঘোষণা দেন। পরদিনই রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন দলের সংসদ সদস্যরা। পরে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়ামেও এ বিষয়ে সম্মতি আসে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় দলে বিশৃঙ্খলা করলে তিনি যে লেভেলেরই নেতা হোক তাকে বহিষ্কার করা হবে।
জানতে চাইলে গোলাম মসীহ জানান, নির্ধারিত সময়েই বেগম রওশন আহূত সম্মেলন হবে। রওশন এরশাদ সব-সময় সম্মেলনের খোঁজ নিচ্ছেন। চলতি মাসেই দেশে ফিরবেন। তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ। রাজধানীর গুলশান এবং তোপখানা রোডের অফিসে সম্মেলন সংক্রান্ত কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। সব জেলায় যোগাযোগ হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা ঢাকায় আসছেন। সম্মেলনে দলের সব নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিষয়টিকে ঘিরে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে তাকে সরানোর সিদ্ধান্তে ব্যাথিত ও দুঃখিত হয়েছেন রওশন এরশাদ।

সূত্র জানায়, দলের ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে রওশন এরশাদ ও ছেলে সাদ এরশাদ ছাড়া বাকি ২৪ জন রওশনকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তে মত দেন। এ ছাড়া দলের ৪১ জন প্রেসিডিয়ামের সভায় ৩৯ জন সদস্য এ সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেন। দলের এ সিদ্ধান্ত ৩১ আগস্ট জাপা মহাসচিব মুজিবুল হকের নেতৃত্বে একটি দল স্পিকারের কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পিকারকে জানায়। এখন বিষয়টি স্পিকারের হাতে।

রওশন এরশাদ প্রায় এক বছর ধরে অসুস্থ। এর মধ্যে গত ১০ মাস তিনি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শারীরিক এ অবস্থাতেই রওশন এরশাদ আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করলেন। রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যখন রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তখন হঠাৎ করেই জি এম কাদেরের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে রওশনের সম্মেলন আহ্বান অনেককে চমকে দেয়।

জাপার নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করছেন, এই মুহূর্তে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ। রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর বিষয়েও এখন পর্যন্ত দলের প্রভাবশালী নেতাদের থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ভিন্নমত প্রকাশ্যে আসেনি। জি এম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা মনোনীত করার ব্যাপারে সংসদীয় দল ও দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ প্রেসিডিয়ামে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবু শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন রওশন সুস্থ থাকলে তাকে সামনে রেখে দলের একটি অংশ তৎপর হতে পারে।

রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে বিদেশের হাসপাতালে থাকলেও ঢাকায় জাপার সাবেক নেতাদের একটি অংশ তাকে সামনে রেখে তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে রওশন এরশাদ তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহকে সদস্যসচিব করেন। তিনি একসময় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকলেও এখন তার কোনো পদ নেই। পরবর্তীতে সাতজন যুগ্ম আহ্বায়কের নাম ঘোষণা করেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। তারা হলেন- এম এ সাত্তার, দেলোয়ার হোসেন, এস এম এম আলম, এম এ গোফরান, জিয়াউল হক মৃধা, ইকবাল হোসেন রাজু ও কাজী মামুনুর রশীদ। পরবর্তীতে কমিটিতে আরও ১০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সূত্র জানায়, এর মধ্যে কেবল জিয়াউল হক মৃধা জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টার পদে আছেন। তিনি নিজ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দলীয় রাজনীতিতে স্বস্তিতে নেই। বাকিরা একসময় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও গত কয়েক বছর দলের সঙ্গে নেই, দল তাদের রাখেনি।