কালীগঞ্জ উপজেলার একই গ্রামের ৩ জন কৃষক ও কৃষানী পেলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মহেশ্বরচাদা গ্রামের কথা। এ যেন কৃষিতে অবদান রাখার সেরা কৃষি উদ্যেক্তাদের গ্রাম। এক গ্রাম থেকে ৩ জন কৃষক ও কৃষানী পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক। এই গ্রামে প্রায় ১শ নারী ও পুরুষ বাড়ির কাজের পাশাপাশি জৈবি কৃষি ( কম্পোষ্ট সার ও কেচো) উৎপাদন করছেন। বলছি কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাদা গ্রামের কথা। ইতিমধ্যে এই গ্রামটিকে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে আদর্শ কৃষি গ্রাম হিসেবে বলা হচ্ছে। কৃষিতে অবদান রাখায় সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর ২০২২ বুধবার বঙ্গবন্ধ জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন মকবুল হোসেন নামের একজন কৃষক। এর আগে এই গ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন মর্জিনা বেগম ও হেলাল উদ্দিন। এছাড়্ওা পাশের গ্রাম মোস্তবাপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগম ্ও জৈব কৃষিতে অবদান রাখার জন্য জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন।
মকবুল হোসেন, হেলাল উদ্দিন, মর্জিনা বেগম। যাদের নাম এখন দেশ ও বিদেশের অনেকেই জানেন। যাদের কাজই জৈব কৃষি এবং মাটি ও মাটির স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা। তাদের ধ্যান ও জ্ঞান কেচো কম্পোষ্ট সার ও কেচো উৎপাদন সাথে নিরাপদ সবজি উৎপাদন। যা থেকে তারা নিজেরা প্রতি মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেন। একই সাথে এলাকার প্রায় ৪শ কৃষক/কৃষানীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন কেচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদন করতে।
জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকদুর এগিয়েছেন হেলাল, মকবুল ও মর্জিনা বেগম। কেউ বা তৈরি করেছেন পাকা বাড়ি, কেউ বা কিনেছেন মটরববাইক আবার কেউ বা কিনেছেন জমি।আর এ সবই করেছেন জৈব কৃষি বা কম্পোষ্টার সার ও কেচো বিক্রি করে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের প্রথম কোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিজেই তার ইউনিয়নকে নিরাপদ খাদ্যের ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আর এসব কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড।২০০৭-২০০৮সালের কথা। কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের মর্জিনা বেগম, সামছুল-মাজেদা দম্পতি, মহেশ^রচাদা গ্রামের হেলাল উদ্দিন, মকবুল হোসেন, মোস্তবাপুর গ্রামের মনোয়ারা বেগম, সুখজান বেগন, রেবেকা বেগম, মল্লিকপুর গ্রামের আসাদুল-জুথি দম্পতি যাদের নিয়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং আয় বর্ধকমুলক কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করেন কেচো কম্পোষ্ট সার ও কেচো উৎপাদন বিষয়ে। জাপান এবং আমেরিকারসহ বিদেশি বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষক দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এর পর তারা নিজের বাড়িতে কেচো সার,কেচো উৎপাদন এবং জৈব বালাই নাশক তৈরি শুরু করেন। এই সকল উদ্যেক্তাদের সহযোগিতায় নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামে কৃষক ও কৃষানীরা এই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ধীরে ধীর বাড়তে থাকে জৈব কৃষি এবং সার উৎপাদন। বর্তমানে এই ইউনিয়নে প্রায় ৫শ নারী উদ্যেক্তা কাজ করছেন। প্রথমে যারা কাজ শুরু করেছিলেণ তাদের মধ্যে বলরামপুর গ্রামের মর্জিনা বেগম, মহেশ^রচাদা গ্রামের হেলাল উদ্দিন, মোস্তবাপর গ্রামের মনোয়ারা বেগম পেয়েছেন জাতীয় পদক। যা বাংলাদেশের জন্য প্রথম। জৈব কৃষি,কৃষি উদ্যেক্তা এবং নারীদের কর্মসংস্থান করার জন্য একই ইউনিয়নের এই ৪জন জাতীয় পদক পেয়েছেন। এছাড়াও এই ইউনিয়নে যে সকল নারী পুরুষ জৈব কৃষি কাজ করে বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করছেন তাদের মধ্যেই আগামী বেশ কয়েকজন জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
মর্জিনা বেগম জানান, প্রথমে হাঙ্গার ফ্রি ্ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ এবং কিছু সহযোগিতা নিয়ে এই কাজ শুরু করেন। এর পর এক সময় নিজেই বড় জৈব কৃষি উদ্যেক্তা হন। এক সময় নারীদের সংগঠিত করেছেন। প্রতি দিন নারীরা মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে সঞ্চয় করানো শিখিয়েছেন। অনেক নারীদের কেচো কম্পোষ্ট সার ও কেচো উৎপাদন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যার স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন।
মনোয়ারা বেগম জানান, তিনি এলাকার নারীদের নিরাপদ উপায়ে সবজি উৎপাদন, কেচো সার ও কেচো উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ পদ্ধতি এবং গৃহিনীদের কাছ থেকে সেই সব নিরাপদ সবজি ক্রয় করে ঢাকায় পাঠানো এবং নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, সংগঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন।
জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত মকবুল হোসেন বলেন, আমরা প্রথমে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড থেকে কেচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন, বাজারজাতকর এবং নিরাপদ সবজি উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এখন সেই কাজ করতে করতে সরকার জাতীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশেল সর্ববোচ্চ কৃষি পদক পেলাম। খুব আনন্দের।
হেলাল উদ্দিন জানান, মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করছি। এই পদক পেয়ে আমি অনেক খুশি। অনেক কৃষক কৃষানীকে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। আগামীতে আরো ভাল কাজ করবো।
হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের প্রোগ্রাম অফিসার শাহজাহান আলী বিপাশ জানান, হাঙ্গার ফ্রি ওয়র্ল্ডের কর্মীরা নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে উদ্বুর্দ্ধ করেছেন কেচো সার উৎপাদন এবং জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য। তার পরামর্শে ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে ২০/২৫জন কৃষক কৃষানী আগ্রহী হয়ে কাজ শুরু করেন। এখন তারা সফল উদ্যেক্তা । বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, রায়গ্রাম সহ আশে পাশের অনেক ইউনিয়নের নারী পুরুষ জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার অর্জন করেছেন। তাদের দেখাদেখি এলাকার প্রায় ৫শজন নারী এই কাজে যুক্ত হয়েছেন এবং পরিবারে অবদান রাখছেন। তিনি জানান, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে সেই সময় আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করা হয়েছিল।
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ রনি জানান, তার ইউনিয়ন বাংলাদেশের সেরা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক নারী পুরুষ জৈব পদ্ধতি চাষাবাদ করেন এবং কেচো সার ও কেচো উৎপাদন করেন। ইতিমধ্যে তিনি তার ইউনিয়নকে নিরাপদ খাদ্যের জোন হিসেবে ঘোষণা করেছেন। চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ আরো জানান, ঝিনাইদহ ৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার নিজ্ওে নিরাপদ সবজি এবং কম্পোস্ট সার উৎপাদনের জন্য কৃষক-কৃষানীদের সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, এই ইউনিয়নের ৪ জন উদ্যেক্তা ইতিমধ্যে জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে মহেশ্বরচাদা গ্রাম থেকে ৩ জন এবং পার্শবর্তী মোস্তবাপুর গ্রাম থেকে ১জন। বাংলাদেশে আর কোন ইউনিয়ণ নেই যে এক ইউনিয়ন থেকে ৪ জন জাতীয় কৃষিক পদক পাওয়ার।
উপজেলা কৃষি অফিসার শিকদার মোহায়মেন আক্তার জানান, এটা কালীগঞ্জের জন্য গর্বের বিষয়। বাংলাদেশে এই প্রথম একটি ইউনিয়নের ৪জন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন। এতেই বোঝা যায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে কৃষি অনেকদুর এগিয়েছে।কালীগঞ্জের কৃষকেরা অনেক ভাল তারা কৃষিটাকে মনে প্রাণে নিয়ে কাজ করে।