আগামী অধিবেশনে পাস হবে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল’

songsod

বিদ্যমান শিরোনাম দফার পরিবর্তে ‘দেশের সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই পেনশন কাঠমোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে আনীত বিল’ প্রতিস্থাপন করে ২১তম জাতীয় সংসদ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল, ২০২২।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিলের খসড়ায় শব্দগত কিছু বিষয় সংশোধন ছাড়া পুরো কাঠামো অভিন্ন রেখে বিলটি আইনে পরিণত করতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উপস্থাপন করা হবে। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিলটি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

সূত্র জানায়, খসড়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিলের শিরোনাম ছিল, ‘জনগণের বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্য কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত অভাবগ্রস্থতা ও দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্তিকল্পে আনীত বিল।’

সূত্র জানায়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা কালে শিরোনামটিকে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর পরিবর্তে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনাকে ব্যাপক রূপ দেওয়ার জন্য বিলের শিরোনাম সংক্ষিপ্ত করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহারের জন্য নতুন শিরোনাম অর্থাৎ ‘দেশের সর্বস্তরের জনগনকে একটি টেকসই পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে আনীত বিল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২২ এর উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা বলেন, ‘দেশে সাধারণ জনগণের বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্য কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত অভাবগ্রস্ত ও দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধিও কারণে ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাভুক্তির জন্য কেনো আইনি বিধান নাই। সে প্রেক্ষাপটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের দফা (ঘ) এর বিধান অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ও অন্যান্য অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের বিধান অন্তর্ভুক্তকরণপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন আবশ্যক।

অর্থমন্ত্রী বলেন, যুগপোযোগী একটি পেনশন আইনের অধীনে বাংলাদেশে পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ, পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যাবলি সম্পাদনের লক্ষ্যে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ দেশের নাগরিকগণকে অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদানের পথ সম্প্রসারিত হবে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ও দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিতকল্পে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২২ শীর্ষক খসড়া বিলটি প্রণয়ন করা সমীচীন।’

এর আগে চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ বিষয়ে প্রণীত কৌশলপত্রের ওপর সে সময়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর) আব্দুর রউফ তালুকদার একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ৩২ পৃষ্ঠার খসড়া কৌশলপত্রে নতুন এই পেনশন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকসহ বিভিন্ন দেশে চলমান পেনশন ব্যবস্থা তুলে ধরা হয়।

এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা’ প্রবর্তন হলে ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪,৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু করেন এবং ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, তাহলে অবসরের পর তিনি প্রতি মাসে ১৮,৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন।

জানা গেছে, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা’ চালু করতে আলাদা একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে।

জনসাধারণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহারে। তার একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়ে ছিলেন। সেই নির্দেশনার ভিত্তিতে অর্থ বিভাগ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে।

সূত্র জানায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করছি। আমাদের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর যা ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তি অবসর গ্রহণের পরও গড়ে ২০ বছর আয়ু থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ভরশীলতার হার ৭.৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশে এবং ২০৭৫ সালে ৪৮ শতাংশে উন্নীত হবে। গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীল হার বিবেচনায় আমাদের বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।

প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য দিক:
১৮-৫০ বছর বয়সী সব কর্মক্ষম নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সরকার যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে এ পদ্ধতি স্বেচ্ছাধীন থাকবে যা পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক করা হবে। ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পৃথক পেনশন হিসাব থাকবে ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। এ পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে।

মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমা দিতে পারবে। সুবিধাভোগী বছরে ন্যূনতম বাৎসরিক জমা নিশ্চিত করবে। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হবে এবং পরবর্তীতে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করা হবে। সুবিধাভোগী আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বর্ধিত অর্থ জমা করতে পারবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা (৬০ বছর) পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে।

পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে জমাকারীর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশন স্কীমে জমাকৃত অর্থ কোন পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা প্রদানকারী মৃত্যুবরণ করলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।

পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। নিম্ন আয়সীমা নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কীমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ ফান্ডে জমাকৃত টাকা নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।