রংপুরে কোন্দলে ডুবল নৌকা, হারাল জামানত

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারণার মাঠ কিংবা আলোচনায় না থেকেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে চমকে দিয়েছিলেন হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। কিন্তু ভোটযুদ্ধে সেই চমক বিপর্যয় হয়ে ফেরত এসেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে অকল্পনীয় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন তিনি। ডালিয়ার চেয়ে মোস্তফা পেয়েছেন সাড়ে ৬ গুণ ভোট। নৌকার প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

প্রার্থী বাছাইয়ে যোগ্যদের মূল্যায়ন না করাই এই পরাজয়ের কারণ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। তবে কেউ কেউ বলছেন, ডালিয়ার পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে কাজ করেছে নিজ দলের দ্বন্দ্ব। মহানগর আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের প্রভাবে এখানে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে।

নির্বাচন ঘিরে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগের অর্ধডজন প্রার্থী মাঠে জোরালো প্রচারণা চালিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আলোচনায় ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাফিউর রহমান সফি, সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, রংপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম, রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন, মহানগর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আতাউর জামান বাবু ও জাতীয় শ্রমিক লীগের রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এমএ মজিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু। তখনও ডালিয়াকে নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি তিনি নিজেও কখনও মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাননি। শেষ পর্যন্ত তাঁকেই করা হয় নৌকার মাঝি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা স্বীকার করেছেন, রংপুরে দলীয় কোন্দলের কারণেই প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ এখানে যাঁরা মাঠে ছিলেন, তাঁদের কোনো একজন মনোনয়ন পেলে ভোটযুদ্ধ সহিংসতায় রূপ নিত।

ডালিয়া ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। এর আগে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় এলাকার উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখেননি। ভোটের মাঠে তাঁর পরিচিতিও ছিল না। ব্যক্তি ইমেজে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও তিনি আওয়ামী লীগ ও নৌকার কথা বলে প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে পিছিয়ে পড়েছেন নিজ দলের অন্তর্কোন্দলের কারণে। এমনকি নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রেও হেরেছেন ডালিয়া। নগরীর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৯২। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা পেয়েছেন ১৬৬ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন পেয়েছেন ১৪৪ ভোট। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাহ আলম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। ভোটের কয়েক দিন আগে দলীয় কোন্দলের কারণে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁকে না জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাফিউর ও সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তিও অনেক আগে থেকে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রয়েছেন। এমনকি এ দু’জনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। ভোটের আগেও তাঁরা ডালিয়ার প্রচারণায় পৃথকভাবে অংশ নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই দ্বন্দ্বের কারণেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মৌন সমর্থন ছিল রংপুর কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সদ্য বহিস্কৃত সহসভাপতি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতি।

নেতাকর্মীর অভিযোগ, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সম্পাদকের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এর প্রভার পড়েছে ভোটের মাঠে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর কমিটির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, আগে পৌরসভায় ১৫টি ওয়ার্ড থাকলেও সিটি করপোরেশন হওয়ার পর এখন মহানগরীর অধীনে ৩৩টি ওয়ার্ড ও ৬টি থানা রয়েছে। পুরোনো ১৫টি ওয়ার্ডের নেতাকর্মী কার্যকরী কমিটিতে ঠাঁই পেলেও বর্ধিত ১৮টি ওয়ার্ডের একজন নেতাকেও কার্যকরী কমিটিতে নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে আট বছর ধরে মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে ৩৩টি ওয়ার্ড কমিটি। এসব কমিটির মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটির কার্যক্রম থাকলেও বেশিরভাগই নিষ্ফ্ক্রিয়। তার পরও ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে না মহানগর কমিটি। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলের কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে।

এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাফিয়ার ও সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা দলীয় কোন্দল ও সমন্বয়ে সমস্যার কথা অস্বীকার করেন। সফি দাবি করেন, ভোটের মাঠে তিনিসহ দলের নেতাকর্মী সক্রিয় ছিলেন। প্রার্থীর সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছেন। মানুষ কেন ভোট দিল না- বুঝতে পারছেন না।