‘উজ্জীবিত’ নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখার কৌশল বিএনপির

হামলা-মামলা ও গণহারে গ্রেপ্তার সত্ত্বেও সরকার পতনের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচির সফলতায় বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা ‘উজ্জীবিত’ বলে দলটির হাইকমান্ড মনে করছে। তাঁদের এ চাঙ্গাভাব ধরে রাখতে আজ সোমবার থেকে জেলা সফরে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে তাঁরা নেতাকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। দেবেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা। দলের ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের ১০ দফা দাবির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। এতে প্রত্যেক নেতাকর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও সচেষ্ট হবেন বলে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

বিএনপির দাবির পক্ষে জনমত তৈরির পাশাপাশি সরকারবিরোধী বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে এবং যুগপৎ আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকও শুরু করেনে দলের নেতারা। এর অংশ হিসেবে আজ সোমবার বিকেলে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা বৈঠক করবেন।

বিএনপি নেতারা জানান, সরকার পতনের দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ‘শুভ সূচনায়’ আশাবাদী তাঁরা। বিশেষ করে গত ৩০ ডিসেম্বর সরকারবিরোধী গণমিছিলে জনসম্পৃক্ততা ও নেতাকর্মীর ঢল সবাইকে আশান্বিত করেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, লুটপাট, নির্যাতন, গণতন্ত্রহরণ আর মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে এ দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এখন দেশের মানুষ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি আর জীবনযাপনের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় সবাই কষ্টে আছেন। তাই এ সরকারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে শুধু বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছে।

তৃণমূলের মনোবল ধরে রাখার পরিকল্পনা: সারাদেশে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও রাজপথের প্রত্যেক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নেতাকর্মীর এ মনোবল ধরে রাখতে নানা কৌশল নিয়েছে দলটি। একদিকে রাজপথে সক্রিয় নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীর পাশে আজীবন থাকার ঘোষণায় আরও বেশি উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপির চলমান আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে দলটি। এরই মধ্যে আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের আজীবন দায়িত্ব নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। পাশাপাশি আহতদের পুরো চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা হচ্ছে। কারাবন্দি নেতাকর্মীর পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছে দলের হাইকমান্ড। প্রত্যেক নেতার বাসায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাঠিয়ে তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিচ্ছেন। মামলা পরিচালনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিনা পয়সায় তাঁদের মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের সাহস জোগাচ্ছেন বলে দলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স সমকালকে জানিয়েছেন।

নেতাকর্মীরা জানান, তাঁদের হারানোর কিছু নেই। মামলা-হামলায় জর্জরিত প্রত্যেক নেতাকর্মী। কর্মসূচিতে সক্রিয় না থাকলেও মামলা থেকে রেহাই নেই। ঘরে থাকলেও গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে, কারাগারে যেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় যে কোনো উপায়ে তাঁদের আন্দোলনে সফল হতে হবে। তাঁরা জানান, ঘোষিত কর্মসূচিতে উপস্থিতি বাড়ছেই। চেয়ারপারসনসহ দলের শীর্ষ তিন নেতার অনুপস্থিতি মাঠের রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলছে না।

জনমত তৈরির উদ্যোগ: বিএনপির ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখা ও আন্দোলনের ১০ দফাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এরই মধ্যে এসব রূপরেখা ও দাবিকে বুকলেট আকারে ছাপিয়ে প্রত্যেক জেলায় পাঠাতে শুরু করেছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। বুকলেটে রূপরেখার পাশাপাশি দাবিগুলোকেও তুলে ধরা হয়েছে। এসব বুকলেট দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সরকারি সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী নেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠন, এমনকি বিএনপিবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও যুব সংগঠনকে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।

আর এসব কাজে সমন্বয় করতে কেন্দ্র থেকে নেতারা জেলা ও মহানগরে যাচ্ছেন। তাঁরা জেলাভিত্তিক বিভিন্ন সভা, সেমিনারের মতো কর্মসূচিতে এ রূপরেখা নিয়ে কথা বলবেন। আপাতত কেন্দ্রীয়ভাবে প্রত্যেক ইউনিটে অল্পসংখ্যক বুকলেট সরবরাহ করা হলেও জেলা নেতাদের বৃহৎ পরিসরে এসব ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।

বিএনপির যেসব নেতা টেলিভিশন টকশোতে অংশ নেন তাঁদের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করে রূপরেখার পক্ষে জনমত তৈরিতে কথা বলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির বিভিন্ন পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গেও বৈঠক করবে দলটি।

যুগপৎ আন্দোলনের চুলচেরা বিশ্লেষণ: হামলা-মামলা ও বাধার মধ্যেও আন্দোলনের ১০ দফা দাবি আদায়ে রাজপথে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। গত শুক্রবার বিএনপি ছাড়াও সাতদলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জোট এবং এলডিপি ও জামায়াত গণমিছিলের আয়োজন করে। রাজধানীর সাত স্পটে পৃথকভাবে এসব দল ও জোটের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। বিএনপির গণমিছিলের ‘সাফল্যে’ অন্য দলের কর্মীরাও উচ্ছ্বাসিত। স্মরণকালে এত বড় মিছিল তাঁরা নিজেরাই দেখেননি বলে জানান।

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও গত ২৪ ডিসেম্বর সারাদেশে গণমিছিল করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বাধা ও গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটে। শুক্রবার সকালে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের ব্যানারে সাভারে বড় মিছিলের আয়োজন করে সংগঠনটি। জুমার পর মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় মিছিলের চেষ্টাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। তাঁদের এসব মিছিলে ব্যাপকসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা গেছে।

তবে সাতদলীয় জোটের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও সমন্বয়ের অভাবে নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে তেমন ছিল না। বিষয়টি নিয়ে জোট নেতাদের মধ্যেই সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে। বিশেষ করে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীর অনুপস্থিতি জোটের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি করছে।

নতুন ঘোষিত ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নেতারাও চমক দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ নিয়ে জোটের মধ্যেই অসন্তোষ চলছে বলে জানা গেছে। ১২ দলীয় জোটের মিছিলে আশানুরূপ উপস্থিতি না থাকলেও নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন জোট নেতারা।

কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি এককভাবে গণমিছিলের আয়োজন করে। বড় শোডাউন করে সক্ষমতা প্রমাণ রাখে দলটি।

বিভিন্ন দল ও জোটের প্রথম যুগপৎ কর্মসূচির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু জানান, গণমিছিলে তাঁদের সামান্য ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। এটাকে সামনে রেখে আগামীতে কর্মসূচি সফল করার বিষয়ে তাঁরা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন।

আরও দলকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা: সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোকেও এক প্ল্যাটফর্মে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আরও বেশ কয়েকটি দলকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে কাজ করছে বিএনপি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব দলকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে টানতে পারবেন বলে মনে করছেন যুগপৎ আন্দোলনের জন্য গঠিত লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা।

লিয়াজোঁ কমিটির নেতা ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জানান, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে না, এই লুটেরা সরকারের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাই সেই আন্দোলনে অংশ নেবেন।