সরকারি চাকরি আইনেই গলদ

সরকারি চাকরির বয়স শেষে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটির (এলপিআর) নিয়ম ছিল ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত। এর পর প্রক্রিয়াটির নামকরণ হয়েছে অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল)। রূপান্তরিত এ পদ্ধটিকেই গলদ হিসেবে অভিহিত করছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে, অবসরোত্তর ছুটি মানে অবসরের পর ছুটি। কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে চলে গেলে সরকারের কাছ থেকে তাঁর ছুটির প্রশ্ন আসবে কেন? অন্যদিকে সরকারি চাকরি আইনে পিআরএল ভোগরতদের সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বলা হলেও এ অবস্থায় বেতনসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়াকে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

সদ্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার অবসরে যাওয়ার এক দিন পরই সরকারদলীয় রাজনৈতিক কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবার নতুন আলোচনায় এসেছে। অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত কিনা, সে প্রশ্ন নতুন করে উঠেছে। এ কর্মকর্তাকে সংশ্নিষ্ট দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পদে অধিষ্ঠিত করার ঘোষণা এখন পর্যন্ত আসেনি। তবে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার দলীয় রাজনীতিতে জড়ানোর ঘটনা আগে দেখা যায়নি।

এলপিআরের নিয়ম থাকাকালে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী এলপিআর শেষ হলেই পূর্ণ অবসরে যেতেন। আর পিআরএলের নিয়মে কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রথমেই পূর্ণ অবসরে চলে যাচ্ছেন, তাই তাঁদের ছুটির প্রশ্ন উঠছে না। ছুটির প্রশ্ন তাঁদের ক্ষেত্রেই আসে, যাঁরা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সরকারি চাকরি-সংক্রান্ত একাধিক বইয়ের লেখক ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, সরকারি চাকরি আইনে পিআরএল ভোগকারীদের সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বলা হয়েছে। কিন্তু তাঁরাই আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান। এটা আইনের দুর্বলতা। সরকার এই জায়গায় নতুনভাবে চিন্তা করতে পারে।

কবির বিন আনোয়ার সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সমীচীন নয়। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন অংশ নিতে পারেন না। একইভাবে অবসরোত্তর ছুটিতে থাকার সময়ও সরকারি কর্মচারীরা যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অবশ্যই থাকা দরকার।

২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনের ৫২ ধারায় বলা হয়েছে, চাকরি থেকে অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক কর্মরত থাকা ছাড়া কোনো ব্যক্তির বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরি বা কোনো প্রকল্পে চাকরি, অন্য কোনো পেশা, ব্যবসা পরিচালনা এবং বিদেশ যাত্রার জন্য সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তবে সরকার বিশেষ ক্ষেত্রে, অনুরূপ ভিন্ন চাকরি বা পেশা গ্রহণ, ব্যবসা পরিচালনা বা বিদেশযাত্রা বাতিল করে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।

সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সমকালকে বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যতক্ষণ পুরোদমে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, ততক্ষণ রাজনীতিতে জড়ানোর সুযোগ নেই। অবসরের নিয়মটাকে আপনি পিআরএল বলেন আর এলপিআর বলেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর রাজনীতিকে পৃথকভাবে ব্যাখ্যা দেন, সেটা এক ধরনের ভাওতাবাজি। কী আর বলব, এসব বিষয় যাঁরা ধরার কথা, তাঁরাই উস্কে দিচ্ছেন। এতে আমলাতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সামরিক সরকারের মতো বিএনপির আমলেও সাবেক আমলাদের এমপি-মন্ত্রী বানিয়ে লোভ লাগানো হয়েছে। এখনও সেটা চলছে। এটা একদিকে আমলাতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে দেশের রাজনীতির দেউলিয়াত্বের প্রমাণ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে চাকরির বয়স বাড়ানোর সময় এলপিআরকে পিআরএল হিসেবে অভিহিত করে নতুন নিয়ম চালু করা হয়। এ ক্ষেত্রে এলপিআরে থাকার সময় সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ সফরে যেতে গেলে সরকারের অনুমোদন দরকার হতো। এসব অনুমোদন-সংক্রান্ত কাজে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনেক ঝক্কি পোহাতে হতো। এ সমস্যার সমাধান করতে তা পিআরএল পদ্ধতিতে রূপান্তর হয়। এখন পিআরএলে যাওয়া কাউকে বিদেশে যেতে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক এক মন্ত্রিপরিষদ সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এলপিআরের প্রক্রিয়াটি ব্রিটিশ আমলে চালু করা। ওই সময়ের অনেক মৌলিক আইন এখনও অপরিবর্তিত আছে। অবসরের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি বহাল থাকা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার অনুমোদন-সংক্রান্ত বিষয়টি একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই সমাধান করা যেত। ব্রিটিশদের প্রবর্তিত নিয়মগুলো অনেক ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে প্রণয়ন হয়েছিল। সময়ের প্রয়োজনে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেসব বিষয়ের দূরবর্তী প্রভাব চিন্তা না করে হুট করেই পরিবর্তন আনা ঠিক নয়।

তবে এ বিষয়ে ভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ইউসুফ হারুন সমকালকে বলেন, সর্বশেষ সরকারি কর্মচারীদের চাকরির বয়স প্রকৃত অর্থে বাড়ানো হয়েছে এক বছর। আর এক বছর এলপিআর হিসেবে গণ্য। তাই এই নিয়ম থাকাতে সমস্যা দেখি না। তিনি বলেন, পিআরএলে সরকারি চাকুরেদের স্বাধীনতা অনেকটা বেড়েছে কিন্তু আর্থিক সুবিধা কিছুটা খর্ব হয়েছে। কারণ এলপিআর থাকার সময় চাকুরেদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বেতনের সঙ্গে যোগ হতো। পিআরএলে সেটা হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব কিছু আইন-বিধিতে লিখিত থাকতে হবে, এমন কথা নেই। কিছু বিষয়ের রীতি, নীতি ও প্রথা আইন-বিধির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এসব বিষয় অনুসরণ না করলে সেটা সমালোচনার জন্ম দেয়, তৈরি হয় খারাপ দৃষ্টান্ত।

কবির বিন আনোয়ার আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রয়াত এইচ টি ইমামের চেয়ারে বসেছেন। দলটির নেতাদের কারও কারও ধারণা, তাঁকে দলটির নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।