মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া

Michael Madhusudan Dutt

বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই আজকের বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতা, বাংলা মহাকাব্যে বিপস্নবের সুর-ছন্দ; কুসংস্কার ধর্মান্ধতার প্রতিবাদে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা কবি মধুসূদনের রচনায় খুব সচেতনভাবেই উঠেছে। ইতিহাসের ভেলায় চড়ে কালকে জয় করে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে একেবারে বুকের মাঝে ধারণ করে শির উঁচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে অনেক রক্তের দামে কেনা ভালোবাসার জন্মভূমি আমাদের বাংলাদেশ। দেশের ঐতিহ্যবাহী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ‘কপোতাক্ষ নদে’র তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি সোনার চামচ মুখে নিয়ে এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাসাহিত্যের মহাপুরুষ, বাংলা কাব্য প্রথম আধুনিক কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের বাংলা ভাষার প্রবর্তক এবং আধুনিক বাংলা কাব্যের মহান রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

বাংলা কাব্যে সাহিত্যে আধুনিকতার, বিদ্রোহের প্রতিবাদের ভাষার চেতনার উন্মেষ কবি মধুসূদনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই আলোকিত করেছে। এই বৃহত্তর ভারত উপমহাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনকালে যশোর জেলার কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদার পিতা-রাজনারায়ণ দত্ত আর মাতা স্নেহময়ী জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে, বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে প্রিয় কবি মধুসূদন দত্ত এই দুঃখ-কষ্ট; সুখ-শান্তির পৃথিবীতে এসেছিলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি মনোরম পরিবেশ পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা সাগরদাঁড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বিখ্যাত ‘কপোতাক্ষ নদে’র সঙ্গে মিলেমিশে তার অমৃত সুধা সতত পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন। কালের সাক্ষী হয়ে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মধুসূদনের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ। অথচ কপোতাক্ষ নদের জলকে মায়ের পবিত্র দুধের সঙ্গে তুলনা করে কবি মধুসূদন রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত সনেট কবিতা (চতুর্দশপদী কবিতা) ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি।

মূলত ‘কপোতাক্ষ নদ’ রচনা করে কবি মধুসূদন তার জন্মভূমির একটি নদীর এবং স্বদেশের প্রতি অপার প্রেম গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ দেখিয়েছেন এবং প্রকাশ করেছেন। এই কবিতায় স্বদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কৃতজ্ঞতাবোধ মমত্ববোধের মধ্য দিয়ে কপোতাক্ষ নদের যে জল, তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি কবি মধুসূদনের অন্যান্য সনেট কবিতার মধ্যে বিখ্যাত এবং অন্যতম।

কবি ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় বলেছেন- সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে পিতা রাজনারায়ণ দত্তের কাছ থেকে শিশু মধুসূদন মেধা মনন জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি তার মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছ থেকেই প্রথম রামায়ণ, মহাভারত পাঠ শিক্ষা নিয়েছিলেন। যা পরবর্তী কালে কবি প্রতিভা বিকাশে মেধা সমৃদ্ধিতে অত্যন্ত পেরনা যুগিয়েছিল। আর এ কারণেই কবির জীবনে তার স্নেহময়ী মায়ের প্রভাব ছিল খুবই গভীর। তাই কবি মধুসূদন তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রেম শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের ভেতর দিয়ে এক অনুপম উজ্জ্বল আদর্শ রেখে গেছেন।

ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় শিশু মধুসূদনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কিন্তু গায়ের পাঠশালায় শিশু মধুসূদন বেশি দিন লেখাপড়া শিখতে পারেননি। কারণ, পিতা রাজনারায়ণ দত্ত কর্মের জন্য তার পরিবার পরিজন নিয়ে কলকাতায় খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানে কিশোর মধুসূদনকে প্রথমে লালবাজার গ্রাম স্কুল পরে হিন্দু কলেজের জুনিয়র শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। কলকাতায় হিন্দু কলেজে অধ্যায়ন করার সময়ে কবি মধুসূদন রাজনারায়ণ বসু, ভোলানাথ চন্দ্র, ভুদেব মুখোপাধ্যায় ও গেরীদাস বসাক প্রমুখ মেধাবী কৃতী ছাত্রকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। এসব বন্ধু ছিলেন কবি মধুসূদনের একান্তই প্রিয় বন্ধু। ওরা পরবর্তীকালে স্ব-স্ব কাজের দ্বারা বড় মাপের মানুষ হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি এই কলেজে পড়ার সময় রিচার্ডসন ও ডিরোজিও নামে দু’জন ইংরেজ পন্ডিতের সঙ্গ পেয়েছিলেন এবং তাদের দ্বারা কবি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, কবি মধুসূদন তার এই প্রিয় দুই পন্ডিতের অন্ধভক্ত ছিলেন। ছাত্র হিসেবে মধুসূদন বরাবরই ভালো ছিলেন, কৃতী ছাত্র হওয়াতে তিনি বৃত্তিও পেয়েছিলেন।

তিনি নারী শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে বিগত ১৮৪২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আর এই জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়া অবস্থায় কবি মধুসূদনের জীবনে এক বাক পরিবর্তন হয়। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এ সময় কবির মনেপ্রাণে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, ভবিষ্যতে বড় কবি হতে হলে ইংরেজি সাহিত্যচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর তখন থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যকে মনেপ্রাণে প্রাধান্য দিতে থাকেন এবং ইউরোপ বিভুঁইয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। শুধু কি তাই! কবি মধুসূদন এ সময় তাসো, ভার্জিল, হোমার ও মিলটনের মতো জগৎবিখ্যাত ইংরেজ কবি লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এসব কবির মতো তিনিও বড় কবি হবেন এ আকাঙ্ক্ষা মনেপ্রাণে বিশ্বাস এবং ধারণ করতেন।

কবি মধুসূদন বিগত ১৮৪৩ সালে ৯ ফেব্রম্নয়ারি তার বাপ-দাদার ধর্ম হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্মগ্রহণ করেন এবং নতুন করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাম ধারণ করেন। মূলত এই নতুন নামেই তিনি পরিচিত হন। এ সময় তিনি হিন্দু কলেজ ছাড়েন এবং কিছুদিন পরে কবি মধুসূদন কলকাতার শিবপুরে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। এরপর বিশপস কলেজ ত্যাগ করে তিনি ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে চলে যান। সেখানে তিনি ‘মাদ্রাজ মেলঅর্ফান এসাইলাস’ বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষতার পদে চাকরি নেন। এখানেই থাকা অবস্থায় তিনি ইংরেজিতে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ইংরেজিতে লেখা মধুসূদনের কবিতা-প্রবন্ধ সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ভাষাও শিখতে থাকেন। কবি মধুসূদনের ইংরেজিতে লেখা কবিতাগুলোকে কখনো উপেক্ষা করা যাবে না।

কারণ, সেগুলো তার কবিসত্তার এক মূল্যবান অংশ। মাদ্রাজে বসবাসকালে কবি মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটাভিস নামে এক নীলকর কন্যাকে বিবাহ করেন। সংসার জীবনে কবির চার সন্তান হয়েছিল। যদিও তাদের এই দাম্পত্য জীবন তেমন সুখের ছিল না। তারপর এক সময় ইংরেজ কন্যা এমেলিয়া হেনরিয়েটার সঙ্গে কবি মধুসূদনের পরিচয় হয়। কালক্রমে দু’জনার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কবি মধুসূদনের জীবনে সুখে-দুঃখে হেনরিয়েটা সব সময়ের জন্য পাশে থাকতেন। ১৮৫৫ সালে জানুয়ারিতে মধুসূদন কলকাতা আসেন, তার কিছুদিন পর হেনরিয়েটাও মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কবি মধুসূদন কলকাতায় আসার পর তিনি দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি নিজেকে একান্তে চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বিশেষ করে মায়ের ভাষা বাংলা চর্চার প্রতি তার আগ্রহটা বেড়ে যায়। এই বাংলা ভাষার যে অপার শক্তি, অসম্ভব আকর্ষণ আছে তা কবির মনে নাড়া একান্তে দিয়েছিল। আসলে কবি মধুসূদন মনেপ্রাণে বুঝতে পেরেছিলেন যে, অন্যের ভাষা নয়; আপন মাতৃভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যই আপনাকে অনেক বেশি বিকশিত, প্রচারিত ও সম্মানিত করবে এবং অন্তরের গভীরে এক প্রেরণা উৎসাহিত করতে সহায়ক হবে।

মূলত, মাতৃভাষা বাংলা কতটা আপনার, সমৃদ্ধির এবং প্রেরণার উৎস হতে পারে তা কবি কড়ায়-গন্ডায় যা পুনরায় বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। কবি ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় এভাবেই বলেছেন- হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন- তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি কবি মধুসূদন যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে বাংলা কাব্য জরাগ্রস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করছিল। বাংলাসাহিত্যাকাশে কবি মধুসূদনের আগমনে জরাগ্রস্ত বাংলা কাব্য যেন প্রাণ ফিরে পেল এবং নতুনের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হলো। চরম সত্যিটা এই যে, মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা কাব্য যে পুনরুজ্জীবন বিকশিত হয়েছিল তা আজকের এই বাংলা কাব্যের ধারাবিহকতার দিব্য প্রকাশ।

(সাত পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব )