মধুসূদনের শেষ জীবন ভয়াবহ অর্থাকষ্টে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল ( তৃতীয় পর্ব )

‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (সনেট) কবি মধুসূদনের এক বিস্ময়কর অমর সৃষ্টি। সনেটের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যাকাশে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। পাশ্চাত্য সনেটের অনুসরণে রচিত সনেট বাংলা সাহিত্যে একদিকে যেমন নতুন, অন্যদিকে এক নব অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। কবি মধুসূদন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’গুলোর অধিকাংশ রচনা করেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সেস শহরে অবস্থান সময়ে। এই সনেটগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে ১ আগস্ট মাসে। রামগতি ন্যায়রত্ন ওই গ্রন্থ সম্পর্কে নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন এভাবে- ‘কবি যৎকালে ইউরোপে গমন করিয়া ফরাসি দেশস্থ ভরসেলস নগরে অবস্থান করেন, তৎকালে এই কাব্য রচিত হয়।

কবির স্বহস্তে লিখিত ইহার উপক্রমভোগ লিথোগ্রাফে মুদ্রিত হইয়াছে। তদ্বারা তাহার হস্তলিপি দর্শনেচ্ছুগণ পরিতৃপ্ত হইবেন। মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর উভয়বিধ ছন্দের চতুর্দশ পঙক্তিতে একশতটি পৃথক বিষয় ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে।’ এ ছাড়া চতুর্দশপদী কবিতার পাশাপাশি কবি মধুসূদনের বিভিন্ন সময়ে রচিত ‘নানা কবিতা’ নামে গৃহীত হয়েছে। আমাদের কবি মধুসূদন একটা সময়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

শেষ জীবনে ভয়ঙ্করভাবে অর্থাকষ্টে ঋণগ্রস্ত ও অসুস্থতার ফলে কবি মধুসূদনের জীবন ভয়াবহ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তারপর সব চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করে ১৮৭৩ সালে ২৯ জুন কলকাতার এক হাসপাতালে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। আর এই ৪৯ বছরে কবি মধুসূদন বাংলাসাহিত্যে যা দিয়েছিল তা সত্যিই অতি মূল্যবান ও দুর্লভ। যতদিন বাংলাসাহিত্য বাংলা কাব্য পৃথিবীতে টিকে থাকবে ততদিন কবি মধুসূদনের অসাধরণ বৈচিত্র্যময় সৃচনশীল অমর সৃষ্টি বেঁচে থাকবে।

কবি মধুসূদন যে সময়ে মৃতুবরণ করেছিলেন, সে সময়ে তিনি বেশকিছু রচনা শুরু করেও শেষ পর্যন্ত শেষ করে যেতে পারেননি। কলকাতায় কবির সমাধি লিপিতে এপিটাফে কবি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে কবি হৃদয়ের যে বেদনা তা প্রকাশ করেছেন। এখানে কবি মধুসূদন বলেছেন- দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে (জননীর কোলো শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন পরিশেষে, বাংলা কাব্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি, আধুনিক কবি ও বাংলা কাব্যে নতুন ধারা (অমিত্রাক্ষর) প্রবর্তনকারী প্রিয় মহাকবি মধুসূদন বাংলা শব্দে ছন্দেভাবে শিল্পে একজন কালজয়ী মহাপুরুষ।

কালের সন্তান, যুগের কণ্ঠস্বর, মানবতার বক্তা মহানায়ক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি অসম্ভব অনিন্দ সুন্দর অমর সাহিত্যকর্ম; বাংলাসাহিত্যকে কাব্যকে অনেক অনেক কালদীপ্ত আলো হয়ে জগৎ সংসারে সাহিত্য ভুবনে আলোকিত করবে। মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যকর্মে মানবিকতা, স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের যে অপার উন্মেষ ঘটেছে; তা বাংলা কাব্যকে বাঙালি জাতিকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে। হে মহাকবি, যুগস্র্রষ্টা কাব্যপ্রেমিক মধুসুদন তুমি তোমার আপন সৃষ্টির মাঝেই সতত জাগ্রত।

( মাইকেল মধুসূদনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কাল থাকছে…….. চতুর্থ পর্ব )