মাইকেল মধুসূদনের কাঠবাদাম গাছ-বিদায় ঘাট আজও কালের সাক্ষী

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাঠবাদামগাছটি এখন মৃতপ্রায়। মধু প্রেমিক পর্যটকরা এই কাঠবাদাম গাছতলায় বসে বিশ্রাম নেন। এখন কালের সাক্ষী এই কাঠবাদাম গাছটি বয়সের ভারসাম্য আর ধরে রাখতে পারছে না। তার বড় বড়ডালগুলো মুল শরীর থেকে খসে পড়ছে। কালজয়ী কবি মাইকেল মধুসূদন নেই, কপোতাক্ষ ও তার কৈশোর – যৌবন হারিয়ে বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়ে পলি পড়ে মরতে বসেছে। তবুও কবির স্মৃতি ধরে টিকে আছে কাঠবাদাম গাছটি।

 

এখানে রয়েছে কবির স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বাদাম গাছ। এর নিচে বসে তিনি কবিতা লিখতেন। এর পিছনে রয়েছে বিদায় ঘাট।

 

কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রাম। কপোতাক্ষ নদের কূলেই প্রায় ৩০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠবাদাম গাছ। খুলনা বিভাগের মধ্যে এটিই একমাত্র ৩০০ বছর বয়সের কাঠবাদাম গাছ। গাছটি হওয়ায় জায়গাটি এখন কাঠবাদাম ঘাট নামে পরিচিত। এই বাদামতলার ঘাটে মধুসূদন পরিবারের লোকজন স্নান করতেন । মধুসুধন শৈশবে এই কাঠবাদাম তলে বসে কবিতা লিখতেন বলে এলাকায় জনশ্রুতিও আছে। কিন্তু মধুসুদনের প্রথম জীবনীকার যোগেন্দ্রনাথ বসু তার মাইকেল মধুসুদনের প্রথম জীবনীকার যোগেন্দ্রনাথ বসু তার মাইকেল মধুসুধন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে লিখেছেন- মধুসূদনকে ১২-১৩ বছর বয়সের সময় তার পিতা শিক্ষাদানের জন্য তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে সংকল্প করলেন। পিতার ইচ্ছানুসারে মধুসুদন কলকাতায় গেলেন। মধুসূদনের অপর এক জীবনীকার ড. সুরেশ চন্দ্র মৈত্রী তার মধুসূদন রচনাবলী গ্রন্থ উল্লেখ করেছেন- ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন কলকাতায় যান। উপরিউক্ত দুজন জীবনীকারের কথা বিশ্বাস করলে কবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ী এলাকার জনশ্রুতি কিছুটা দ্বিমত হয়।

মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পর কপোতাক্ষ নদ দিয়ে বজরায় করে এই কাঠবাদাম তলার ঘাটে এসে তার বজরা ভেড়ান। পিতা জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় এই বাদামতলায় তাবু খাটিয়ে ১৪ দিন কাটান কবি। পরে এই কাঠবাদাম তলা থেকে ৪০০ গজ উত্তরের বিদায় ঘাট দিয়ে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে চলে যান মধুসূদন।

এই বিদায় ঘাটে কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি পাথরে খোদাই করে একটি স্মৃতিফলক দেওয়া হয়েছে।

মধুসূদন খ্রিষ্ঠধর্ম

গ্রহণের পর কপোতাক্ষ

নদ দিয়ে বজরায় করে

এই কাঠবাদাম তলার

ঘাটে এসে তার বজরা ভেড়ান।

পিতা জমিদার রাজ নারায়ন

দত্ত তাকে বাড়িতে

প্রবেশ করতে না

দেওয়ায় এই

বাদামতলার তাবু

খাটিয়ে ১৪দিন কাটান কবি ।

মধুস্মৃতি ধরে রাখার প্রয়াসে যশোর পরিষদ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৪ সালে কাঠবাদাম গাছের গোড়া চারপাশ থেকে পাকা করে গেথে প্লাষ্টার করে দেয়।

কাঠ বাদাম ফল পাকে মার্চ – এপ্রিলের দিকে। কাঠ বাদাম পাকলে এর গায়ের রঙ হয় লাল। পাকার আগে রঙ থাকে সবুজ। কাঠ বাদাম পেকে তলায় পড়ে থাকে। গাছের তলায়ও চারা হতে দেওয়া যায়। আবার অনেকেই পাকা কাঠবাদাম পেড়ে মাটিতে পুতে রাখেন চারা তৈরীর জন্য।

তবে অধিকাংশ কাঠবাদাম পাখিরা নষ্ট করে ফেলে। কোনো কোনো পাখি কাঠবাদাম ঠুকরিয়ে খায়। আবার অনেক পাখি ঠোঁট দিয়ে ছিড়ে নিয়ে যায়। কাঠ বাদাম গাছে সব সময় টিয়া পাখিদের বসতে দেখা যায়। বয়সের ভারে জরাগ্রস্থ হয়ে পড়ায় গাছটিতে অনেক ছোট বড় গর্তেই বাসা করেছে পাখিরা, ডিম পাড়ে বাচ্চাও ফোটায়।

মধু কবির বাড়িতে বেড়াতে আসা অনেকেই বিরল প্রজাতির এই কাঠবাদাম পেড়ে খায়, আবার তলা থেকে কুড়িয়েও খায়। মধুকবির স্মৃতি হিসেবে কাঠবাদামে বড় বড় লাল পাতা ব্যাগে বাড়িতেও নিয়ে যান অনেকে। আবার এর পাশে ঘাটটিতে অনেকেই জল নিয়ে যাইবো বাড়িতে শুধু তার স্মৃতি ধরে রাখতে।

মধু প্রেমিক দর্শনার্থী, পর্যটক, পিকনিক পার্টির লোকজন এই কাঠবাদাম গাছতলায় বসে বিশ্রাম নেন।

এখন কালের সাক্ষী এই কাঠবাদাম গাছটি বয়সের ভারসাম্য আর ধরে রাখতে পারছে না। তার বড় বড়ডালগুলো মুল শরীর থেকে খসে পড়ছে। কালজয়ী কবি মাইকেল মধুসূদন নেই, কপোতাক্ষ ও তার কৈশোর – যৌবন হারিয়ে বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়ে পলি পড়ে মরতে বসেছে। তবুও কবির স্মৃতি ধরে টিকে আছে কাঠবাদাম গাছটি। কবি ছোটবেলায় এই গাছের গোড়ায় বসে কবিতা লিখতেন।

তবে কাঠবাদামগাছটি এখন মৃতপ্রায়। দর্শনার্থী মিনারুল ইসলাম অপু বলেন, মধুমেলাতে আসবো আর এই কাঠবাদাম তলায় আসবো না সেটা তো হয় না যতবারই সাগরদাঁড়িতে আসি একবার হলেও এই কাঠ বাদাম গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়ে যায় স্মরণ করি মহাকবি মধুসূদন দত্তকে। যতদিন বেঁচে থাকব কবি স্মৃতি স্মরণ করে যাব ভালো বাসা তার জন্য অবিরাম থাকবে।

 

কবির স্মৃতিবিজড়িত বিদায় ঘাট ১৮৩০ সালে মধুসূদন সাগরদাঁড়ি ছেড়ে কলকাতা খিদিরপুর যান। তারপর দীর্ঘ পথচলা। কিন্তু ভোলেননি তার জন্মস্থানের কথা, কপোতাক্ষ নদের কথা। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ১৮৬২ সালে কবি স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নদী পথে বেড়াতে আসেন সাগরদাঁড়িতে। কিন্তু মায়ের দেখা পাননি। দাম্ভিক পিতার ধর্ম ও কুসংস্কার নাস্তিক ছেলেকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। তখন তিনি চলে যান মামার বাড়ি পাইকগাছার কাঠিপাড়া গ্রামে। মামা বংশধর ঘোষের বাড়ি তিনি আপ্যায়ন পান। সেখান থেকে তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য কপোতাক্ষ নদের পাড়ে তাঁবুতে কয়েক দিন অপেক্ষা করে আবার কলকাতায় চলে যান। এরপর তিনি আর দেশে ফেরেননি। যে ঘাট থেকে তিনি এ শেষ বিদায় নিয়েছেন তা আজও ইতিহাসে বিদায় ঘাট নামে পরিচিত। কবির এই স্মৃতিবিজড়িত বিদায় ঘাট আজও পর্যটকদের অন্তরের স্থান করে নিয়েছে।