সাহিত্যে নোবেল পাচ্ছেন কে?

২০২৩ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার কে পাবেন সে সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকাল পাঁচটায় স্টকহোমে অবস্থিত সুইডিশ একাডেমীর সংবাদ সম্মেলন কক্ষে তা ঘোষণা করা হবে। পুরস্কার পর্ষদের প্রধান তুলে ধরবেন তাদের সিদ্ধান্তের যুক্তিসমষ্টি। পুরস্কার প্রদান করা হবে ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে। নতুন নোবেল লরিয়েট পাবেন নগদ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার, যা বাংলাদেশি দশ কোটি টাকার সমান।

২০১৫ সালে বেলারুশিয়ার সাংবাদিক স্বেতলানা আলেক্সেয়িভিচকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেয়া হলে সারা পৃথিবীর সাহিত্যমোদিরা একটু থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাহলে সাংবাদিকতাও সাহিত্য হয়ে গেল? বিশ্বজুড়ে এ প্রশ্নের অনুরণন চলেছে দীর্ঘকাল। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে মার্কিন কণ্ঠশিল্পী বব ডিলানকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের পর থেকে নোবেল পুরস্কারের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৯ সালে পিটার হানৎকা, ২০২০ সালে কবি লুই গ্লিক এবং ২০২১ সালে আব্দুররেজাক নোবেল পুরস্কার পাবেন সেটাও ছিল কল্পনাতীত । তারা কেউই প্রথম সারির লেখক নন। এসবের মধ্য দিয়ে উপর্যুক্ত ধোঁয়াশা ঘনীভূত হয়েছে। ফলে নোবেল পুরস্কার নিয়ে অনুমান দুরূহ হয়ে পড়েছে।

২.

২০১৮ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন সচিব নিয়োগ করা হয়েছে এবং অধিকতর সুবিবেচনার জন্য নির্বাচকমণ্ডলীতে চারজন লেখককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কার্যত ২০১৫ থেকে নির্বাচনী ব্যাকরণ অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে প্রতীয়মান হয় যে, ইউরোপের কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি নোবেল পুরস্কারের ঐতিহাসিক পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত রয়েছে।

লৈঙ্গিক ও ভৌগোলিক সমতার স্বার্থে এবার নোবেল পুরস্কার দূরপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার কোনো কথাসাহিত্যিকের হাতে গেলে বেশ শোভন হয়। জাপানি ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় লেখক। তার জন্ম ১৯৪৯ সালে। ২০১০ থেকে প্রতি বছর তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এবং এ যাবৎকাল মুরাকামী ভক্তরা প্রতি অক্টোবরেই আশাহত হয়েছেন। মুরাকামির রচনায় কি আলফ্রেড নোবেল-কথিত মানবতার পক্ষে আদর্শিক অবস্থান নেই? তিনি নোবেল পুরস্কার পাবেন এমন আশা এখন অনেকেই আর করেন না।

তার চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ হলেন কেনিয়ার কথাসাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালে। তাঁর রচনার কেন্দ্রে রয়েছে মানবতার পক্ষে ও ক্ষমতার বিপক্ষে সুস্পষ্ট আদর্শিক অবস্থান। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের নাম বদল করে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ লিটেরেচার’ রেখেছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ইংরেজির পরিবর্তে তিনি মাতৃভাষায় লিখে যাচ্ছেন। তার ষাট বছরের সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধতা। এ বছর তাকে পুরস্কার দিলে সবদিক থেকেই সুবিচার করা হবে।

কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের মতে, ১৯০৭ সালে লিও তলস্তয়কে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এ কারণে যে, তাঁর রচনায় তত্ত্বকে বাস্তবায়নের ইশারা অনুপস্থিত। মার্ক্স কথিত ‘প্র্যাক্সিস’-এর অনুপস্থিতি নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গোকে পেছনে বেঁধে রেখেছে। ১৯৮৬ সালে ওলে সোয়িঙ্কা সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কারকে আফ্রিকা ভূখণ্ডে নিয়ে আসেন। কিন্তু তারপর থেকে আফ্রিকা যেন বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। চিনুয়া আচেবের নাম বারবার এলেও নির্বাচকমণ্ডলী অন্য কাউকে বেছে নিতে তৎপর ছিলন। নোবেল পুরস্কারের শিকে ছিঁড়ুক বা না ছিঁড়ুক, নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গোর ‘উইজার্ড অফ দ্য ক্রো’ এবং ‘ড্রিমস ইন আ টাইম অফ ওয়ার’ বাদ দিয়ে কারো বিশ্বসাহিত্যের পাঠ সম্পূর্ণ হতে পারে না।

৩.

সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী বাজি ধরা হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বাজিগরদের একটি তালিকায় যে দু’জনের নাম রয়েছে, সর্বপ্রথমে তারা হলেন- চীনা লেখিকা চান শুয়ে ও নরওয়ের জন ফসি। এ তালিকায় নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গোর অবস্থান ষষ্ঠ এবং মুরাকামির অবস্থান নবম। জয়স ক্যারোল ওটসের নামও আছে, কিন্তু অনেক শেষে।

অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে যে, এ বছর বাজিগরদের কাছে চীনা লেখিকা চান শুয়ের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডলে এই চীনাভাষী কথাসাহিত্যিক অপরিচিত বললে অন্যায্য হয় না। ১৯৫৩ সালে তার জন্ম। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ১৯৬৬ সালে এলিমেন্টারি স্কুল পাস করার পর তিনি আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পেশায় তিনি একজন দর্জি বা খলিফা। তবে নিজে নিজে অনেক পড়াশোনা করেছেন তিনি।

১৯৮৫ সালে সব ‘বাবলস ইন দা ডার্টি ওয়াটার’ নামে একটি ছোট গল্প প্রকাশক মধ্য দিয়ে সাহিত্যের জগতে তার প্রবেশ। পরের বছর প্রকাশ করেন উপন্যাসিকা ‘ওল্ড ফ্লোটিং ক্লাউড’। পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি প্রচুর লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন। সেগুলি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে তিনি সমালোচকদের নজরে এসেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘ডায়ালগস ইন প্যারাডাইয’, ‘ফ্রন্‌টিয়ার’, ‘ভার্টিকেল মোশন’, ‘বেয়ার ফুট ডক্টর’ ইত্যাদি। এ যাবৎ তিনি আটটি উপন্যাস, ৫০টি উপন্যাসিকা (নভেলা) এবং ১২০টি ছোটগল্প প্রকাশ করেছেন। অনেকে তাকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক এবং নিরীক্ষাধর্মী কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একদিকে তিনি প্রশস্তি লাভ করেছেন, অন্যদিকে তার সমালোচনাও কম নয়। অনেকের মতে, তার গ্রন্থপাঠ এক ক্লেশকর অভিজ্ঞতা, যার শেষে তেমন কোনো সন্তুষ্টিবোধ হয় না।

৪.

১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণকারী জন ফসি সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী (জিনিয়াস) একশত ব্যক্তির একজন বলে চিহ্নিত। নরওয়ের এই কথাসাহিত্যিক নাট্যকার হিসাবে সমধিক পরিচিত। এ বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য ইউরোপকে বাদ রাখার সিদ্ধান্ত থাকলে জন ফসিকে কমপক্ষে আরও একবছর অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর ‘এ নিউ নেইম’ এবং ‘সেপ্টোলজি’ অবশ্য পাঠ্য। ১৯৬৮ তে জন্মগ্রহণকারী কার্ল কেনোস্‌গর আরেকজন দুর্ধর্ষ কথাসাহিত্যিক। তিনিও নরওয়ের মানুষ। ‘সেপ্টোলজি’ (সাত খণ্ড) মার্শাল প্রুস্তের ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কেনোস্‌গরের ‘মাই স্ট্রাগল’ অনুরূপ একটি বিশালাকার রচনা (ছয় খণ্ড)। তবে যে দেশেরই হোক, তার বয়োজ্যেষ্ঠরাই হয়তো এ বছর প্রাধান্য পাবেন। আরও কয়েক বছর সম্ভবত অপেক্ষা করতে হবে এই ধীমান লেখককে।

লাযলো ক্রাযনোহোরকাই (জন্ম ১৯৫৪) একজন হাঙ্গেরীয় লেখক। ১৯৮৫ তে প্রকাশিত ‘সাটানটাঙ্গো’ তার বিখ্যাত উপন্যাস। তার ভাষা ও রচনাশৈলী দুরূহ। তবে ২০১৫ সালে স্বেতলানা আলেক্সেয়েভিচের কথা স্মরণ করে বলা যায়, এ বছর ভূ-রাজনৈতিক কারণে তাকে নির্বাচন করা হতে পারে নোবেল পুরস্কারের জন্য।

নোবেল পুরস্কার অনেক সময় একাধিক ব্যক্তিকে দেয়া হয়ে থাকে। এ বছর একই সঙ্গে কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো এবং জাপানের হারুকি মুরাকামিকে দিলে বিশ্বের সাহিত্যামোদী পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে সুইডিশ একাডেমী।