বাংলা সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত 

দেশের বাংলা গানের ভা-ারে এক অতি পরিচিত নাম মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। বাংলা গানে যে কজন মেধাবী গীতিকার রয়েছেন তাদের মধ্য রফিকউজ্জামান অন্যতম। আধুনিক, চলচ্চিত্র, দেশাত্মবোধক সব মৌলিক গানে রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের অবদান অনন্য। দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার রয়েছে এক সমৃদ্ধ ভান্ডার। এই গুনীব্যক্তিকে সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সরকার স্বাধীনতা পদক-২৪ এ ভূষিত করেছেন । গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। যখন সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে এই পুরস্কারের জন্য মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের নাম ঘোষনা করা হচ্ছে তখন তিনি স্বস্ত্রীক যশোরের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। খবর পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, কিছুক্ষণ আগে টিভিতে স্ক্রল দেখে ফোন করে একজন জানালেন আমি স্বাধীনতা পদক-২৪ পেয়েছি। এরপর অনেকেই ফোন করে শুভকামনা জানাচ্ছেন। খবরটি পাওয়ার পর আমি আনন্দিত।তিনি আরও বলেন, একটা ব্যাপার বলতে পারি, আমি একটা কারণে অনেক খুশি। পুরস্কারের জন্য সরকারের কাছে আমাকে কোনো আবেদন করতে হয়নি। আমি কোনো আবেদন করিনি, কাউকে দিয়ে সুপারিশও কখনো করাইনি। দেরিতে হলেও সরকারী ভাবেই আমাকে সিলেকশন করেছে এই পুরস্কারের জন্য। এই কারণেই আমার খুশিটা অনেক বেশি।

 

মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের পৈত্রিক বাড়ি যশোর শহরের খড়কীতে। তিনি খড়কীর ঐতিহ্যবাহী পীরবাড়ির সন্তান। তবে তিনি ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার ফুরসুন্দি-লক্ষীপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মোঃ শাহাদত হোসেন ও বেগম সাজেদা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এক উজ্জল নক্ষত্র। সময় সুযোগ পেলেই এই মানুষটি স্বস্ত্রীক ছুটে আসেন যশোরে । শৈশব ও কৌশরের নানা স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন এখানে – ওখানে।

 

অত্যন্ত আড্ডা প্রিয় এই মানুষটিকে যশোরের মানুষ চেনে রফিক ভাই হিসেবে। তার লেখা বহু গান বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ভা-ারকে করেছে উজ্জ্বলতর ও সমৃদ্ধ। ১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত কত প্রজন্ম পেরিয়ে মাতৃভাষা তথা দেশত্ববোধের মর্মকথা যারা লেখায়-গানে-সুরে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম গীতিকবি, সুরকার, নাট্যকার ও লেখক মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। পিতা মাতার ৯ পুত্র সন্তানের মধ্যে রফিকুজ্জামান দ্বিতীয়। তার বড়ভাই ড. মো. মনিরুজ্জামান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকবি। তার অপর ভাইয়েরা হচ্ছেন- জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার জেলা ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুজ্জামান, বামপন্থী রাজনীতিবিদ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ, মো. আকতারুজ্জামান, মো. ইমামুজ্জামান, মো. এনামুজ্জামান, মো. হাবিবুজ্জামান এবং প্রাক্তন জাতীয় দলের হকি খেলোয়াড় মো. তারিকুজ্জামান।

 

মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখাপড়া শুরু হয় যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে তিনি জিলা স্কুল থেকে ম্যট্রিকুলেশন পাশ করেন। এর পর যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে আই. এ পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছড়া-কবিতা-গল্প এবং গান-রচনা শুরু করেন। অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার থেকেই। স্কুল জীবনের শেষ দিকে পত্রিকায় প্রথম তার কবিতা ছাপা হয়। আর কলেজ জীবনে ঢাকার পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। স্কুলের গায়ক বন্ধুরা তার লেখা গান সুর করে গাইতো। ১৯৬৬ সালে ঢাকা টেলিভিশন তাকে অনুমোদিত সংগীত রচয়িতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৬৮ সালে তিনি যোগদান করেন তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানে। এ বছরই ১২ জুন তিনি যশোর ষষ্ঠীতলাপাড়ার মেয়ে জিন্নাত আরা জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। বড় মেয়ে সানজিদা শারমিন জামান (স্নিগ্ধা) একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ছোট মেয়ে সুহানা শারমিন জামান (পৃথা) লন্ডনে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত রয়েছেন।

 

১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি রেডিওতেই তার চাকরিজীবন অতিবাহিত করেছেন। অনুষ্ঠান প্রযোজক, অনুষ্ঠান সংগঠক, সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক পদে চাকরি করেছেন দেশের প্রায় সকল বেতার কেন্দ্রে। এই সময় একাধারে গীতিকার, কবি, নাট্যকার, নাট্যাভিনেতা, উপস্থাপক, আবৃতিকার হিসাবে রেডিও-টেলিভিশন-শ্রোতাম-লীর নিকট তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ বেতারে প্রচার হওয়া তার লেখা প্রথম গান হলো- ‘মুগ্ধ আমার এ চোখ যখন, মুগ্ধ আমার এ মন / তখন বাতাস আনলো বয়ে তোমার নিমন্ত্রণ।’ তিনি ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু করেন এবং ১৯৭৫ সাল থেকে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। তার লেখা চিত্রনাট্য একাধিক চলচ্চিত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। চিত্রাঙ্কনের সৌখিন চর্চাও চলতে থাকে পাশাপাশি। চলচ্চিত্রে গান লেখার আহবান আসে ১৯৭২ সালে।

 

এ যাবৎ তিনি গান রচনা করেছেন দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে। কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা করেছেন নব্বইটিরও বেশী চলচ্চিত্রের জন্যে। গান লিখতে লিখতেই নাট্যকার রফিকউজ্জামান ১৯৭৫ সালে জড়িয়ে পড়েন চিত্রনাট্য রচনায়। চলচ্চিত্রের জন্যে ক্রমে তিনি হয়ে উঠেন সর্বাপেক্ষা সফল কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও সঙ্গীত রচয়িতা। তিনিই একমাত্র চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের কলকাতার অনেক ছবির জন্যেও একাধারে কাহিনি সংলাপ চিত্রনাট্য ও গান রচনা করেছেন।

 

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য চিত্রনাট্যগুলো হচ্ছে- ‘দেবদাস’, ‘ঘর সংসার’, ‘সৎ ভাই’, ‘কাজললতা’, ‘বিরাজ বউ’, ‘শুভদা’, ‘সহযাত্রী’, ‘ছেলেকার’, ‘জন্মদাতা’, ‘চরম আঘাত’, ‘না বলো না’ এবং ‘মরণের পরে’সহ আরও অনেক। ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান নিজস্ব লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন।

 

একাধিকবার শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’ ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও ২০০৮ সালে ‘মেঘের কোলে রোদ ‘ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর লেখা গান গেয়ে অনেকেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।

 

বাংলাদেশের গানের বহু নামীদামী সঙ্গীতশিল্পী মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছেন অথচ এই মানুষটি রয়ে গেছে আমাদের অজানা। তার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, অ্যান্ড্রু কিশোর, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আবিদা রহমান, রফিকুল ইসলাম,মাহমুদুন নবী, আব্দুল জব্বার, সুববীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী,ডলি সায়ন্তনী,মনির খানসহ আরো অনেকে। তার লেখা বিভিন্ন ধারার গানের সংখ্যা দুই হাজারের অধিক।

 

১৯৯৩ সালে পরিচালক পদে থাকাবস্থায় বাংলাদেশ বেতার থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সিইও ও অনুষ্ঠান প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের মতো একজন মানুষ আজ জীবিতাবস্থায় আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির বাহিরে রয়েছেন যা ভাবলে আমাদের দীনতা ও হীনমানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। আধুনিক গান ও দেশের গান রচনার পাশাপাশি ১৯৯৯ সালের শেষ দিক থেকে তিনি লিখে চলেছেন বাউলতত্ত্ব সমৃদ্ধ গান যা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলের বিশ্লেষণ ও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০০৪-২০০৫ সালে তিনি চ্যানেল এস লন্ডন এর সিইও এবং ২০০৭ সালে বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, ‘যদি মরনের পরে কেউ প্রশ্ন করে’, ‘আমার মন পাখিটা যা রে উড়ে যায়’, ‘আমার বাউল মনের একতারাটা’, ‘চির অক্ষয় তুমি বাংলাদেশ’, ‘পদ্ম পাতার পানি নয়, দিন যাপনের গ্লানি নয়’, ‘মাঠের সবুজ থেকে সূর্যের লাল’, ‘যেখানে বৃষ্টি কথা বলে’, ‘আমি নদীর মতন বয়ে বয়ে’, ‘শুক পাখিরে, পিঞ্জিরা তোর খুলে দিলাম আজ’, ‘আকাশের সব তারা ঝরে যাবে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘ তোমার হাত পাখার বাতাসে মন জুড়ায়ে আসে’সহ হাজারো জনপ্রিয় গান এখনো ঘুরে ফিরছে মানুষের মুখে মুখে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান বিটিভিতে প্রচারিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদীর নেপথ্য কারিগর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।