ফ্যাসিজম থেকে মিডিয়াকে বের করার স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন: নাহিদ

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে বলে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। একইসঙ্গে মিডিয়ার ভেতরে যে ফ্যাসিজম প্রবেশ করেছে সেখান থেকে মিডিয়াকে বের করতে স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রোববার (৪ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় নাহিদ এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে। আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র চর্চার জন্য, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য মুক্ত গণমাধ্যম অতি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার হরণ থেকেই আমাদের আন্দোলনের যাত্রা শুরু। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বলতে চাই, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে গণমাধ্যমে দলীয়করণ, সরকারের হস্তক্ষেপ, সামাজিক চাপ থেকে বের হয়ে গণমাধ্যম কাজ করতে পারবে এবং সাংবাদিকরা তাদের নিরাপত্তা ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মানুষের পক্ষে কাজ করতে পারবে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো লড়াই করেছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, বাংলাদেশ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে৷ এটি আমাদের দেশের জন্য একটি সুখবর হলেও আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ছিল এ দেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি আরও ভালো থাকবে। সেই সূচককে একটি মানদণ্ড ধরলে আমরা এখনো অনেক নিচের দিকে আছি। বিগত ১৬ বছর একটি ফ্যাসিস্ট শাসনের মধ্য দিয়ে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমও দলীয়করণ এবং ফ্যাসিজমের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

‘মিডিয়া এবং ফ্যাসিজমের সম্পর্ক বিগত সময়গুলোতে কী ছিল এবং মিডিয়ার ভেতরে যে ফ্যাসিজম প্রবেশ করেছে সেখান থেকে মিডিয়াকে আমরা কীভাবে বের করতে পারবো সেই বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। কারণ আমরা দেখছি, মিডিয়া এবং ফ্যাসিজমের যে সম্পর্ক বিগত সময়ে ছিল, সেই সম্পর্ক থেকে এবং আদর্শিক আধিপত্যের জায়গা থেকে যদি মিডিয়া বের না হয়, তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তীতে আমরা যে মুক্ত গণমাধ্যম প্রত্যাশা করি এবং জনগণের মিডিয়ার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হবে না। মিডিয়ার সুশাসনের বিষয়টি মিডিয়ার ভেতর থেকেই নিশ্চিত করা উচিত। সেই বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। ’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক ইতিবাচক হবে প্রত্যাশা করে নাহিদ বলেন, যে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিশ্রুতি আমরা সবাই দিচ্ছি, সেটি আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত আসা উচিত। আমি মনে করি, সেই সংস্কারের রূপরেখাগুলো এলে এবং বাস্তবায়ন হওয়া শুরু করলে আমরা বলতে পারবো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে গণমাধ্যমের পরিবর্তনটা দৃশ্যমান হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা আরও বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম নানামুখী চাপের মধ্যে পড়েছে। তবে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ অনেক কমেছে। আমার সময়ে গণমাধ্যমের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের জায়গা একেবারেই কম ছিল। কিন্তু সামাজিক নানা ধরনের চাপ তৈরি হয়েছিল গণমাধ্যমের ওপরে। সেই সামাজিক চাপগুলো কেন বিশেষ বিশেষ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়েছিল, সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই গণমাধ্যমের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। কোনো গণমাধ্যম বন্ধ করার পক্ষে আমরা কখনোই বলিনি। বরং বিভিন্ন সময়ে যখন এই আলোচনাগুলো এসেছে, আমরা গণমাধ্যমের পক্ষে থেকেছি। একইসঙ্গে বিগত সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা বা গণমাধ্যমের ভেতরে নানান ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, সেটার বিরুদ্ধে কখনো কখনো বলেছি৷

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সম্পাদক নুরুল কবীর, পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী প্রমুখ।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করার, প্রতিষ্ঠা করার কিংবা যারা গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের অঙ্গীকার রাখতে চান তার প্রাথমিক ব্যাপার হচ্ছে তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করবেন কিনা। আমাদের দলের পক্ষ থেকে সংগ্রাম আছে, অঙ্গীকার আছে যে- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ লড়াইটা করবো।

তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের এমন কোনো আইন থাকা চলবে না, সরকার যাতে গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরতে পারে। যা যা আইন করেছে তার সবগুলো বাতিল করতে হবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, গত ৫৩/৫৪ বছরের মধ্যে বর্তমানে যে সরকার ক্ষমতায় আছে এর মতো গণমাধ্যমের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কোনো সরকার আসেনি। আগামীতে আসবে কি না জানি না। আমি মনে করি, যারাই ক্ষমতায় যাবেন তারাই বলবেন এই নীতিটাকে তারা কীভাবে প্রণয়ন করবেন। কী রকমভাবে বাস্তবায়ন করবেন।

তিনি বলেন, ওইপাড় থেকে শেখ হাসিনা প্রতিদিন বিবৃতি দেন। আবার আজকাল গ্রুপ বৈঠক করেন। মানে অনলাইনে গ্রুপে গ্রুপে ডেকে তাদের নির্দেশনা দেন। এই সরকার সেটা বন্ধ করার… কোনো একরকম চলতে দেওয়া কি ভালো হচ্ছে? আমার কাছে মনে হয় না। … ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যেসব সাংবাদিকের নামে মামলা করা হয়েছিল, সে মামলাগুলো আছে এখন পর্যন্ত। ড. ইউনূসের মতো মানুষ এই মামলাগুলো তুললেন না কেন? নাহিদরা যতদিন দায়িত্বে ছিল ওরা তুললো না কেন? কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে। যে কারণে তুলতে পারেনি অথবা তোলেনি।

মান্না আরও বলেন, আপনি একেবারে অবাধ মুক্ত সাংবাদিকতা যদি চান, তথ্যের প্রবাহ যদি চান, তার মানে কোনো ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাই কি? এভাবে এখনকার রাষ্ট্র চলবে? যদি সেভাবেই চলতে দেন তাহলে এই যে আওয়ামী লীগ ব্যান করা…ইত্যাদি কথাবার্তা চলছে এগুলো করারও কোনো রাইট নেই। আমি মনে করি অবাধ তথ্যপ্রবাহ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু ওটার একটা সিলিং থাকতে হবে। কারণ দেশ আছে, দেশের স্বাধীনতা আছে, সার্বভৌমত্ব আছে; দেশের অনেক কিছুই আছে যেটা দেশের মতোই হবে, অন্যের মতো হবে না।