গত ৯ মাস আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধই ছিল

a.lig-logo

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে কার্যত নিষিদ্ধই রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সর্বস্তরের নেতকর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন।

দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ পর্যায়ের বেশিরভাগ নেতা পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। এরপর থেকেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ।
তবে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করা হতে থাকে। গত তিন দিনের জোরালো আন্দোলনের মুখে (শনিবার ১০ মে) দিবাগত রাতে উপদেষ্টা পরিষদ এক বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ এবার নিষিদ্ধ হলো আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম। এতে দলটির নেতাকর্মীরা আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পর থেকে পদত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়াড পর্যায়ের নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি সবাই আত্মগোপনে৷ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়েরও অনেক নেতা দেশের বাইরে চলে গেছেন। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এদের মধ্যে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীও রয়েছেন৷ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ বিভিন্ন মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই ৫ আগস্ট বা এর পরপরই দেশের বাইরে চলে যান। আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ৫ আগস্টের আগেই দেশ ছাড়েন। এভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ লীগ। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে এখনো আত্মগোপনেই থাকতে হচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ঝটিকা মিছিল বের করে অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী। আবার এ ধরনের ঝটিকা মিছিলের পরপরই মিছিলে থাকা অনেককে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

গত বছরের ৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীদের মধ্যে ২০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন৷ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন এবং গ্রেপ্তার অব্যাহত আছে। তবে কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, এর সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউ দিতে পারছেন না৷ আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, দলটির ৪০ থেকে ৪৫ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে৷ আবার নেতাদের কারো কারো মতে গ্রেপ্তার হয়েছে আরও বেশি৷

সম্প্রতি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দেশ ছাড়ায় ব্যাপক আলোড়ন, আলোচনা-সমালোচনা ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়৷ গত বুধবার (৭ মে) দিবাগত রাতে আব্দুল হামিদ দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে যান বলে জানা গেছে। গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়।

আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনার পরই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি-এসসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে আসেন। তাদের আন্দোলনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকার বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।

আওয়ামী লীগের সেবব নেতাকর্মীরা কারাগারে রয়েছেন তাদের অনেকেরই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কারাগারে থাকা উল্লেখযোগ্যরা হলেন—আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ প্রমুখ৷

গত শুক্রবার (৯ মে) রাতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালত থেকে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এদিকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যারা দেশের বাইরে আছেন তারা হলেন—দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সুজিত রায় নন্দী, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক এমপি পংকজ দেবনাথ, আওলাদ হোসেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার প্রমুখ৷

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতৃত্বশূন্য এবং আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের দল আওয়ামী লীগ বিচারের মুখোমুখি ও দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের হয়ে গেল। শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।