ক্রমাগত লোকসানে ফের বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যশোরের ‘মণিহার’ সিনেমা হল। ১৯৮৩ সালে ৮ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু হয় দেশের সর্ববৃহৎ এই সিনেমা হলটির। একসময় এটি ছিল এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম হল। কিন্তু দর্শক চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসা সফল সিনেমার সংকট না কাটলে হলটি বন্ধের বিকল্প নেই বলে কর্তৃপক্ষের সামনে। তবে হল বন্ধ করলেও ৪২ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘মণিহার’র স্থাপনা ভেঙে ফেলার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সিনেমা হলটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কলকাতার ‘অভিমান’ সিনেমার শো চলছে। আর সিনেপ্লেক্সে চলছে সালমান শাহ্র ‘বিক্ষোভ’।
মণিহারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, অভিমান সিনেমা এর আগে চারবার চালিয়েছি। একেতো নতুন সিনেমার খবর নেই। তারপর ভালো ছবির সংখ্যা নগণ্য। সর্বশেষ কুরবানি ঈদে তিনটি সিনেমা পেয়েছি। তারপর থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো সিনেমা পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো আর্ট ফিল্ম। ব্যবসার প্রশ্নে আর্টফিল্মতো গলার কাঁটা! কারণ এসব আর্টফিল্ম সিনেপ্লেক্সে দর্শক টানে না। ফলে বাধ্য হয়ে পুরোনো সিনেমা বারবার চালাতে হচ্ছে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার থেকে পরিকল্পনা করছি হলটি বন্ধ করে দেয়ার।
তিনি বলেন, সিনেমা হল বাঁচাতে গেলে বেশি বেশি ভালো সিনেমা বানাতে হবে। আগে প্রতি সপ্তাহে দুটি সিনেমা পেতাম। এখন মাসেও পাই না। মাসে দুটি করে ভালো সিনেমা পেলেও হল চালিয়ে নেয়া যায়। দেশে সিনেমা বানাতে না পারলে আমদানির সুযোগ দিতে হবে। আমরা তো ভারত থেকে সিনেমা আমদানি করে চালাচ্ছিলাম। টিকে ছিলাম। সে রাস্তাও বন্ধ করে দিলো।
হলটির মালিক জিয়াউল ইসলাম মিঠু আরও জানান, মণিহারে দর্শকআসন সংখ্যা এক হাজার ৪৩০টি। বছরের দুয়েক সময় বাদে আসনগুলো শূন্য পড়ে থাকে। প্রতি মাসে বিদ্যুৎবিল আসে প্রায় দেড় লাখ টাকা। ২৫ জন কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎবিল, সিনেমা কেনার টাকাসহ ব্যবস্থাপনা খরচ এ খাত থেকে ওঠে না। হলের সঙ্গে থাকা আবাসিক হোটেলসহ অন্যান্য স্থাপনা থেকে উপার্জিত অর্থে মেটানো হয় হলের লোকসান। এমন পরিস্থিতিতে হলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এটা ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। ভবিষ্যতে কোনো বিকল্প উদ্যোগ নিলেও মূল স্থাপনা ঠিক রাখাসহ চালু থাকবে ‘মণিহার সিনেপ্লেক্স’। প্রয়োজনে সেটির সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে।
উল্লেখ্য, ৯০ দশকের শেষভাগ পর্যন্ত দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩০০টির বেশি। এখন কমতে কমতে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০-৭৫টিতে। তাও আবার চালু নেই এগুলোর সবকটি। নতুন করে বন্ধ হতে যাচ্ছে মণিহার সিনেমা হল। লোকসানের কারণে এর আগেও কয়েকবার বন্ধ হয়েছিল দেশের সর্ববৃত্তম এই সিনেমা হলটি।
মণিহার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ বলেন, আগে সিঙ্গেল স্ক্রিন ছিল, সবাই বলত ভালো পরিবেশ দিলে দর্শক হলে আসবে। এরপর মাল্টিপ্লেক্স করা হয়। যদি সিনেমা না থাকে, ভালো পরিবেশ দিয়ে কী হবে। মাসে অন্তত একটা ভালো সিনেমা থাকলেও টিকে থাকা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, শুধু মণিহার নয়, সব হলমালিকই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
তিনি আরও বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মালিকপক্ষ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। সাফটা চুক্তির আওতায় সিনেমা আমদানি না করতে পারলে হল টিকবে না।
প্রসঙ্গত, মণিহার সিনেমা হল ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। হলটির নকশা করেছিলেন কাজী মোহাম্মদ হানিফ। হলের সাজসজ্জার কাজ সম্পন্ন করা হয় কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের তত্ত্বাবধানে। শুরুতে এই সিনেমা হলে সারাবছর লেগে থাকত সিনেমাপ্রেমীদের ভিড়। হলটি দেখতে দলে দলে দর্শক আসত দেশের নানা প্রান্ত থেকে।