আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিলের পর আরো জোরদার হবে দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযান। এই মুহূর্তে কাউন্সিলকেন্দ্রিক ব্যস্ততা থাকায় আপাতত বড় কোন অভিযান হচ্ছে না। চলবে নিয়মিত কার্যক্রম। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে দেড় হাজার জনের একটি তালিকা করে তা বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়েছে। তারা সবাই অন্য রাজনৈতিক দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে আছে সংগঠন বিরোধী কাজ করার অভিযোগ। আবার কেউবা দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব সম্রাজ্য গড়েছেন। অভিযান চলমান থাকায় বিভিন্ন মাধ্যমে অভিযুক্ত নেতাদের আরো নাম আসছে।
অভিযুক্ত এসব নেতাদের বিষয়ে যাচাই বাছাই করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। দলীয় সূত্র জানায়, চলতি মাসে সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিল শেষ হবে। ডিসেম্বর হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। এই সময়ের মধ্যে তৃণমুলের কাউন্সিল প্রক্রিয়াও চলবে। তৃণমূলের কাউন্সিলে যাতে বিতর্কিত নেতারা স্থান না পান সেজন্য আগেই তাদের তালিকা কেন্দ্র থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
যেসব নেতার নাম তালিকায় আছে তারা দলীয় শাস্তির অংশ হিসেবেই আসন্ন কমিটিতে স্থান পাচ্ছে না। স্ব স্ব জেলা ও থানা কমিটি গঠনের পর তালিকায় থাকা বিতর্কিত ব্যক্তিদের বিষয়ে আইন অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সূত্র জানায়, কাউন্সিলের আগে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে বা সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া বিগত সময়ে তারা নিজস্ব যে বলয় তৈরি করেছে তার অপ্রয়োগ করতে পারে। এজন্য সম্মেলন প্রক্রিয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানো হতে পারে। চলমান অভিযান ক্যাসিনো নিয়ে শুরু হলেও এখন অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তা চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করছে, সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনও এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিরোধী পক্ষ এই অভিযানকে আইওয়াশ বলে প্রচারণা চালালেও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে সরকারের কঠোর নীতির অংশ হিসেবেই এ অভিযান চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে দলের লোক বা আত্মীয় কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি দেখে অনেকে বলছেন, এই মুহুর্তে অভিযান স্থিমিত বলে মনে হচ্ছে।সামনে এটি চলবে কিনা এনিয়েও সন্দিহান অনেকে।
তবে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন তা বাস্তবায়ন করতেই চলমান শুদ্ধি অভিযান আরো জোরদার করা হবে। তবে এখন নিয়মিত অভিযান চলবে। এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া আছে। আগামী ২০ ও ২১শে ডিসেম্বর হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। এছাড়া আগামীকাল হবে কৃষক লীগের কাউন্সিল। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ কাউন্সিল আয়োজন করা হয়েছে। ৯ই নভেম্বর হবে শ্রমিক লীগের সম্মেলন। এছাড়া ১৬ই নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের এবং ২৩শে নভেম্বর যুবলীগের কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। আসন্ন কাউন্সিলে দল এবং সহযোগী সংগঠনের কোন পদেই বিতর্কিতরা স্থান পাবে না বলে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি বলেন, যারা বিতর্কিত, যারা অনুপ্রবেশকারি, সামপ্রদায়িক শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং নানা কারণে বিতর্কিত তাদের আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে আনা হবে না। দলের শীর্ষ নেতারা এমন কঠোর মনোভাব পোষণ করায় স্থানীয় পর্যায়ের বিতর্কিত নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। কেউ কেউ শুদ্ধ হওয়ার ভান করছেন এমন তথ্যও কেন্দ্রে আসছে। রাজধানীতে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর মাধ্যমেই মাঠ পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। যদিও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ আসায় তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নের শুরু। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর এ সংক্রান্ত তথ্য বের হতে থাকে। পরে গ্রেপ্তার হন ওই শাখা যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।
গ্রেপ্তারের পর যুবলীগের এই দুই নেতার দেয়া তথ্যে সংগঠনের চেয়ারম্যানসহ অনেকের নাম বেরিয়ে আসে। নাম আসে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছারের। তালিকায় নাম আসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের। তাদের মধ্যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে। গা-ঢাকা দিয়ে আছেন আরো কয়েকজন। বিতর্কিত কাণ্ডে নাম আসায় ইতিমধ্যে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ তিন নেতাকে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া টেন্ডার কিং বলে খ্যাত কথিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনিও কিছু নেতার নাম প্রকাশ করেন যারা সরাসরি সুবিধাভোগী ছিলেন। দলীয় নেতারা বলছেন, দলের অুনপ্রবেশকারীদের আনাগোনা শুরু হয় মূলত ২০০৯ সাল থেকে। ওই বছরের শুরুতে মহাজোট সরকার গঠন হওয়ার পর অন্য দলের সুবিধাবাদীরা নানা ছুঁতোয় আওয়ামী লীগের ছাতায় আসতে থাকে। পরে আরও দুই দফা সরকার গঠন করায় তৃণমুল পর্যায়ে নানা দলের সুবিধাবাদীরা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে যোগ দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা ও সরকারি দলের একক আধিপত্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সহযোগী সংগঠনগুলোতে দীর্ঘ দিন ধরে একই নেতৃত্ব থাকায় দুর্বৃত্তায়নে বিস্তৃতি ঘটেছে। এসব সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরা সংগঠনের চাইতে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন বেশি। দলীয় ও গোয়েন্দা সংস্থার তরফে এসব তথ্য জমা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
দলীয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করেই ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। শুদ্ধি অভিযানের বিষয়টি সরাসরি তিনি দেখভাল করছেন। এ পর্যন্ত যেসব অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সাধুবাদও এসেছে। এ অবস্থায় দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে এ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দলের ত্যাগি ও দুর্নীতিমুক্ত নেতাকর্মীরা। একই সঙ্গে সরকারের সূধী মহলের পক্ষ থেকেও অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ আসছে। যদিও অভিযান নিয়ে দলে ভিন্ন ধরণের বক্তব্যও আছে।
কেউ কেউ বলছেন, গত ১১ বছরে দল টানা সরকারে থাকায় যে পরিমাণ সুবিধাভোগী অনুপ্রবেশকারী তৈরি হয়েছে তার সংখ্যা অনেক। তাদের সবাইকে এক সঙ্গে ধরতে গেলে সংগঠনেই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কারণ তাদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রী এমপিও হয়েছেন। উপজেলা, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে হুট করে ব্যবস্থা নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় আগে পরিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ ইমেজের নেতাদের দিয়ে সংগঠন সাজাতে হবে। পরবর্তী ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, শুধু রাজনীতিবিদই নয়, প্রশাসনসহ অন্যন্য পেশাজীবীদের মধ্যেও যারা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নিজেদের পরিচয় পাল্টে আখের গুছিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও পর্যায়ক্রমে অভিযান শুরু হবে।
ওদিকে ২০২০ সালকে মুজিব বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আগামী ৮ই ডিসেম্বর থেকে মুজিব বর্ষের কাউন্টডাউন শুরু হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর বছরে আওয়ামী লীগ দল এবং সরকারে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে শুভ বার্তা দিতে চায় বলেও নেতারা জানিয়েছেন। সূত্র: মানবজমিন।