রাবি চারুকলার দেয়ালে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ক্যানভাস

কয়েক মিটার টানা দীর্ঘ দেয়ালকে সাদা ক্যানভাস বানাতে ব্যস্ত একদল তরুণ-তরুণী। কেউ শিরিষ কাগজে দেয়াল মসৃণে ব্যস্ত, কেউ চক বা পেন্সিলে চিত্রকর্মের খসড়া তৈরি করছেন, কেউ আবার প্লাস্টিকের পাত্রে রঙ তৈরি করছেন। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙের তুলির আঁচরে সাদা ক্যানভাস ক্রমশ রঙীন হয়ে উঠছে, আকাঁ হচ্ছে দেয়াল চিত্র।

একেকটা চিত্র যেনো একেকটা ইতিহাসের সাক্ষী। চিত্রগুলোর কোনোটাতে ফুঁটে উঠেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। কোনোটায় জয়নুল আবেদিনের চোখে ৪৩’র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ইতিকথা, কোনোটায় ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত, আবার কোনোটায় ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাসরে সাথে ফুটে উঠেছে নির্যাতনের চিত্রও।

এছাড়া দেওয়ালে গাছের ডালে পাখি, স্বামী ঘুমিয়ে আছে আর বৌ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন, দুই নারী ধান ভানছেন, নারীর নাকে নলক আর কপালে টিপ, গরুর গাড়ির টাপরের (ছাউনি) মধ্যে বর-বধূকে নিয়ে যাওয়া, হাতির সঙ্গে বাচ্চাদের দুষ্টামি, সঙ্গীত চর্চার বিভিন্ন সরঞ্জাম, পালকীতে করে নববধূকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, ঢাক-ঢোল পেটানো, পাহাড়ি মেয়েদের ঝর্ণার ধারে বসে থাকার দৃশ্য, বর-বধূ, মোটরসাইকেল চালককে কুকুরের তাড়া, গরুর গাড়ির চাকায় ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্য, নৌকায় চড়ে শাপলা-পদ্ম ফুল তুলছেন এমনসব গ্রাম-বাংলা আবাহমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের চিত্র ফুটে উঠেছে।

আসন্ন বসন্তকে স্বাগত জানাতে এভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চারুকলা অনুষদের সম্মুখ ভাগের দেয়ালে তৈরি করা হচ্ছে এসব দেয়ালচিত্র। এসব দেয়ালচিত্র প্রস্তুতকরণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীরা জানায়, চলতি বছরের গত ২৯ জানুয়ারী রাত ১০ টা থেকে শুরু করা হয় চিত্র অঙ্কনকে ঘিরে বিভিন্ন কাজ। প্রথমে পুরো প্রাচীর সাদা রং করা হয়। পরের দিন বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন শুরু করা হয়। প্রাচীরের ৫৬টি ব্লকে একটি করে মোট ৫৬টি চিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে। চিত্র অঙ্কনে শিক্ষার্থীরা গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করেছে। একেকটি গ্রুপে তিন থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বসন্ত বরণের প্রস্তুতি হিসেবে অনুষদের একদল শিক্ষার্থী চারুকলা অনুষদ ব্যস্ত সময় পার করছেন। দেয়ালের পাশে বসে নিবিষ্টমনে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’ আঁকতে দেখা গেল অনুষদের শিক্ষার্থী তীর্থ কান্তি প্রামানিককে।

জানতে চাইলে মুচকি হেসে জানালেন, ভিঞ্চি সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী। এই চিত্রটি দিয়েই চারুকলার শিক্ষার্থীরা মানুষের দেহ অবয়ব আঁকতে শিখেন, আর প্রথমকাজ স্মরণীয় করে রাখতে তার এই বিখ্যাত চিত্রকর্ম বেছে নিয়েছেন তিনি।

পাশেই দাঁড়িয়ে থেকে জুনিয়রদের কাজ তদারকিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থী রাহুল দেবনাথ। বসন্ত উৎসবে চারুকলা অনুষদের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, কয়েক বছর ধরে বসন্ত বরণ ও পিঠা উৎসব পালন করে আসছি। এবার সেটা আমরা দুই দিনব্যাপী করব। পাশাপাশি আমরা এবারে বসন্তেও যাত্রা পালা করব। আমাদের আগেই পরিকল্পনা ছিলো চারুকলার সামনের পুরো দেয়াল জুড়ে দেয়ালচিত্র করবো। আর সেটার জন্য বসন্তের আগের সময়কে ঠিক করেছি কারণ এসব কাজ আমাদের মাঝে উৎসবের আমেজটাকে আরো বৃদ্ধি করবে।

রাহুলের বক্তব্যের সত্যতা মিলল একটু সামনে এগিয়েই। চারুকলা মঞ্চের দিকে এগোতেই চোখে পড়লো যাত্রাপালার প্রশিক্ষণ চলছে। যাত্রাপালার প্রশিক্ষণার্থীদের একজন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মাহিন। তিনি জানালেন, এবারে চারুকলায় মঞ্চস্থ হবে ঐতিহাসিক যাত্রাপালা ‘আনার কলি’। তার জন্য চলছে জোর প্রস্তুতি।

চারুকলা অনুষদ ছাড়াও বিশ^বিদ্যালয়ে বসন্তবরণ উৎসব পালনে প্রস্তুত হচ্ছে অন্যান্য বিভাগগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাম্পাসে বসন্তবরণে বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠন যাত্রাপালা, পিঠাউৎসব, গানের অনুষ্ঠান, নাটক প্রভৃতির আয়োজন রেখেছে।#