শহরের আশ্রমমোড়ে রোশনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা, আটক হয়নি কেউ

যশোর শহরের রেলরোডের আশ্রম মোড়ের নিজ বাড়িতে রোশনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় কোতয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। হত্যাকান্ডের পর তিন দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ হত্যাকান্ডের কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। আটক হয়নি কোন আসামি। ঘটনাস্থল থেকে একটি ছুরি ও রক্ত মাখা ওড়না উদ্ধার করা হয়। পাওয়া যায়নি রোশনির ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি। তবে রোশনির বাড়ির ভাড়াটিয়া কাম কেয়ারটেকার (গ্যারেজ মিস্ত্রি) শফিয়ার রহমান ও তার ছেলে সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে। রোশনি হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঘোপ কবরস্থানে পিতার কবরের পাশে রোশনির দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
২৯ আগস্ট সন্ধ্যায় আশ্রম মোড়ের নিজ বাড়িতে রোশনির জবাই ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা লাশ উদ্ধার করা হয়। রোশনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার মা উপশহর ডি ব্লকের মৃত রিয়াজুর রহিম খন্দকারের স্ত্রী সেবিনা বেগম (৭৫) মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) কোতয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি অজ্ঞাত দেখানো হয়। মামলায় সেবিনা বেগম বলেছেন, রোশনি স্বামী ১৯/২০ বছর আগে মারা গেছে। রোশনির দুই ছেলে মেয়ে। ছেলে সরকারি কর্মকর্তা। পিএইচডি করার জন্য বর্তমানে আমেরিকাতে আছে। মেয়ে ঢাকায় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোন করে। রোশনি আশ্রম রোডের নিজ বাড়িতে একা বসবাস করতো। ঘটনার দিন (২৯ আগস্ট) সোমবার বিকেলে রোশনির মা সেবিনা বেগম রোশনির বাড়ি আসে। এসে গেটের কলিং বেল বাজালে কোন সাড়া শব্দ পায় না।

রোশনির বাসার সামনের মেইন গেট খোলা থাকায় ভিতরে যায়। যেয়ে দেখি ঘরে গ্রীলে তালা লাগানো। পাশের রান্না ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি মেয়ের ঘরের আলমারি খোলা। তখন সেবিনার সন্দেহ হলে ঘরের পিছনে গিয়ে বেড রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে বেডরুমের জিনিস পত্র এলোমেলো তছনছ করা। তাৎক্ষনিক সেবিনার ছোট মেয়ে ডাঃ দিলরুবাকে ফোন করা হলে তিনি এসে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে গ্রীলের তালা ভেঙ্গে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। সেবিনাও পুলিশের সাথে ছিলেন। ঘরে ঢুকে সেবিনা বেগম দেখেন ঘরের ডাইনিং রুমের ফ্লোরে প্রচুর রক্ত। ধস্তা ধস্তির চিহ্ন রয়েছে। রক্ত দেখে বেড রুমে যান সেবিনা। সেখানে বক্স খাটের চালির নিচে রোশনির লাশ পাওয়া যায়। ঘটনার দিন ২৯ আগস্ট সোমবার সকালে রোশনি তার নাতির সাথে মোবাইলে আমেরিকা কথা বলে।

রোশনির মা সেবিনার ধারনা অজ্ঞাত নামা কে বা কারা পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ২৯ আগস্ট সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টার মধ্যে যে কোন সময় রোশনির গলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো চাকু দিয়ে হত্যা করে মৃত্যুর রহস্য গোপন করার জন্য রোশনির মৃত দেহ বেড রুমের বক্স খাটের চালির নীচে লুকিয়ে রাখে। ওই দিন লাশ উদ্ধারের পর রাতেই ময়না তদন্তের জন্য জেনারেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করা হয়। মঙ্গলবার (৩০আগস্ট) ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার (৩১ আগস্ট) লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রোশনির বড় ছেলে আমেরিকা প্রবাসি মুন্তাসির আহমেদ রাতুল আমেরিকা থেকে ও মেয়ে (পালিত) রাশনা মাহাতাব ঢাকা থেকে আসার পর বুধবার আছরবাদ ডিব্লক জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে ঘোপ কবরস্থানে পিতার কবরের পাশে রোশনির লাশের দাফন করা হয়। পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন জানান, রোশনি হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশের পাশাপাশি পিবিআইও কাজ করছে। তবে এখনো পর্যন্ত রোশনি হত্যাকান্ডের কোন ক্লু উদ্ধার হয়নি।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কোতয়ালি থানার এস আই খান মাইদুল ইসলাম রাজিব জানান, মামলাটি ক্লুলেস। তারপরও পুলিশের একাধিক টিম রোশনি হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে কাজ করে যাচ্ছে। এঘটনায় ওই রাতেই বাড়ির ভাড়াটিয়া কাম কেয়ার টেকার শফিয়ার ও তার ছেলে সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়া হয়েছে। বুধবার (৩১ আগস্ট) খুলনা থেকে সিআইডির ক্রাইম সিনের একটি টিম যশোর আসে রোশনির হত্যাকান্ডের আলামত সংগ্রহ করতে। তারা ফিংগার প্রিন্টসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহের চেষ্টা করে। রোশনি হত্যাকান্ডের পর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়নি। চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আকিকুল ইসলাম জানান, রোশনির সুরোতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতকারি কর্মকর্তা চাঁচড়া ফাঁড়ির এস আই সাইদুর রহমান ঘটনাস্থল থেকে একটি চাকু ও রক্ত মাখা একটি ওড়না উদ্ধার করে।
এদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্র বলেছে, ২০০২ সালে রোশনির স্বামী প্রানী সম্পদ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান মনু লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ওই সময় আশ্রম এলাকার জনৈক ফারুকের সাথে রোশনির অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমনকি অসুস্থ স্বামী ঘরের মধ্যে রোগ যন্ত্রনায় ছটফট করলেও রোশনি ফারুকের সাথে ঘরের মধ্যে মনোরঞ্জনে ব্যস্ত সময় পার করে। বিষয়টি ওই সময় আশ্রম এলাকায় ব্যাপক আলেচিত ঘটনায় পরিনত হয়। এ ঘটনায় ফারুকের স্ত্রী ফারুককে ঝাটাপেটা করে।

এছাড়াও রোশনির সাথে তার স্বামী মনুর এক বন্ধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সব বিষয় আশ্রম এলাকায় বেশ চাউর হয়ে উঠে। পরে ছেলে মেয়েদের চাপে পড়ে ক্ষ্যান্ত হয় রোমনি। কিন্তু তারপরও গোপনে বিভিন্ন লোকের সাথে যোগাযোগ রাখতো রোশনি। এরপর চাকুরির সুবাদে ছেলে আমেরিকা ও মেয়ে ঢাকায় পড়ালেখা করার জন্য গেলে ভাড়াটিয়া হিসেবে শফিয়ার ওই বাড়ি ভাড়াটে হিসেবে উঠে। সূত্র বলেছে, শফিয়ারে বাড়ি সদরের বলাডাঙ্গা কাজিপুর। আশ্রম মোড়ে তার একটা সাইকেল গ্যারেজ আছে। গ্যারেজের ইনকামের টাকা দিয়ে তার সংসার চলে। শফিয়ারের স্বভাব চরিত্রও ভালো না। প্রথম স্ত্রী ক্যানসারে আক্রন্ত হয়ে মারা যায়। পরে ছেলের বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে দেখতে যেয়ে তাকে বিয়ে করে। সম্প্রতি দ্বিতীয় স্ত্রীও শফিয়ারকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। সূত্র গুলির ধারনা, প্রত্যেক মানুষের একটি যৌবিক চাহিদা আছে। শফিয়ার ও রোশনি ওই বাড়িতে দুজনেই একা থাকতো। তাদের দুজনের চারিত্রিক একটা মিল আছে। তাদের পূর্বের কোন সম্পর্ক অথবা জোর পূর্বক রোশনির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে যেয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। আবার সম্পত্তির লোভে এলাকার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রোমনি হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকতে পারে। ওই সন্ত্রাসী গ্রুপটি প্রায় এক বছর আগে রোশনির বাড়ির কেয়ারটেকার শফিয়ারকে জোর পূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সূত্র গুলি জানায় রোশনির বাড়ির পশ্চিম দিকে ছোট সীমানা প্রাচীর। প্রাচীরের পরে পুকুর ও সিএন্ডবির জায়গা। ওই জায়গায় স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপের নিরাপদ আস্তানা। ওই সন্ত্রাসীদের রোশনির বাড়ির পিছনে আড্ডা দিতে নিশেধ করলে কেয়ারটেকার শফিয়ারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি রোশনির ২০ শতক জমি বিক্রি করার জন্য বিভিন্ন লোকের সাথে কথাবার্তা চলছিলো। রোশনি বাড়ি বিক্রি করে আমেরিকা প্রবাসি ছেলের কাছে চলে যাবার জন্য মনস্থির করছিলেন। বাড়ির বিক্রির জন্য কয়েকজনের সাথে দরদাম হয়েছিলো। কিন্তু সব কিছুই হচ্ছিল অতিগোপনে। কারা কখন রোশনির বাড়ি আসে। কি আলাপ করে। এ বিষয় গুলি সম্পর্কে শুধুমাত্র রোশনির কেয়ারটেকার শফিয়ার ও তার মা সেবিনা বেগম জানতেন। পুলিশ সব বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে বলে জানান ডিবির ওসি রুপন কুমার সরকার।