ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন ২৭ মুক্তি পাগল যুবক ও এক গৃহবধূসহ ২৯ ব্যক্তি শহীদ হলে দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছরের মত এবারও পালিত হলো ঐতিহাসিক কামান্না দিবস। কামান্না দিবস পালন উপলেক্ষ্যে মঙ্গলাবার নির্বাচন কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব বিশ^াস লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)’র অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খ.ম. আমির আলী। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শৈলকুপা উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার রহমত আলী মন্টু, মাগুরা জেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আব্দুর রহমান, ঝিনাইদহ জেলা কমান্ডের যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবু জাফর ফিরোজ প্রমূখ। বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান লাল ও আসাদুজ্জামানের সঞ্চালনায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসরাইল হোসেন, রইস উদ্দিন, মেহের আলী, নজরুল ইসলাম, খান রাকিবুল হাসান দিপু, নজরুল ইসলাম মাখনসহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাথেন।
ভয়াল কামান্না দিবস। সেদিনে ঝিনাইদহের তৎকালিন শৈলকুপা থানা সদর থেকে ৮-৯ মাইল পূর্বদিকে কুমার নদ ঘেঁষে কামান্না গ্রামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন ২৭ মুক্তিপাগল যুবক ও এক গৃহবধূসহ ২৯ ব্যক্তি। বগুড়া ইউনিয়নের সবুজে ঘেরা এ গ্রামটিতে ঘটে যায় ইতিহাসের হৃদয় বিদারক ও ঘৃণ্যতম ঘটনা।
দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছরের মত এবারও পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক কামান্না দিবস। তবে এত রক্তক্ষরণের পরও পূরণ হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের লালিত স্বপ্ন, যা অধরাই রয়ে গেছে বিগত ৫৩ বছরেও। তাদের দাবী, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি যাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটন কেন্দ্র, উন্নত মানের সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তৎকালিন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, কোরবান আলী, ইউসুফ আলী, নূর-ই-আলম সিদ্দিকী প্রমূখ রাজনীতিবদি তাদের আশ^স্তও করেছিলেন। কিন্তু কেউই কথা রাখেনি।
কামান্নায় একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর স্থাপনের লক্ষ্যে কাজি শাহিনুজ্জামান ওরফে কাজি রাসেল তার নিজের ৫ শতাংশ জমি লিখেও দিয়েছেন। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৯শ ৫০ টাকা ব্যয়ে ওই জমিতে নির্মাণকাজ করার সময় নতুন করে একটি সাইনবোর্ড সেটে দিয়েছে “মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ” নামে। অথচ, ১৯৭১ সালের ৬টি গণকবর ঘিরে ওই বছরই প্রতিষ্ঠা করা হয় কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতিসৌধ। আর সেটি নতুন করে বানাতে সরকারিভাবে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে বছর দু’য়েক হলো। একইস্থানে একই ঘটনায় দু’টি স্মৃতিসৌধ বানানোর মানে খুঁজে পাচ্ছেন না এলাকাবাসি ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসি জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে ৩৫ জনের মত স্বাধীনতাকামি যুবক সেনা কর্মকর্তা শমসের হোসেনের নেতৃত্বে আশ্রয় নেন কামান্না হাইস্কুলের পশ্চিমদিকে মাধব ভৌমিকের বাড়িতে, কেউ আবার পার্শবর্তী কিরণ শিকদারের বাড়িতে। নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ না করেই তারা ঘুমিয়ে পড়েন যার যার মত। খবরটি শৈলকুপা রাজাকার ক্যাম্পে পৌঁছাতে আর বিলম্ব হয় না। শোনা যায়,পাকিস্তানী বাহিনীর অনুগত চর হিসেবে ‘মহান দেশপ্রেম’র কাজটি করেন গ্রামের বর্তমাণে প্রয়াত এক স্কুলশিক্ষক। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী কামান্নায় যাচ্ছে- এ খবরটি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানো হলেও কোন অজানা কারণে শেষতক তা আর কামান্নায় মুুিক্তযোদ্ধাদের কানে পৌঁছেনি। ফলে তৎকালিন মহকুমা শহর ঝিনাইদহ, থানা শহর শৈলকুপা আর পার্শবর্তী মাগুরা থেকে কয়েকশ’ হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের স্থানীয় সহচর রাজাকার, আল বদর ও আল শাম্স মাঝ রাত থেকেই ঘিরে ফেলে মাধব ভৌমিকের বাড়ি, আশেপাশের এলাকা, অবস্থান নেয় ভারি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে। রাত পোহানোর কয়েক ঘন্টা আগেই তারা অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে ঘুমকাতুর দামাল ছেলেদের ওপর। মুহুর্মূহু গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে বীর সন্তানদের। কিন্তু অস্ত্র হাতে থাকলেও তা থেকে গুলি বের করে হানাদারদের মোকাবিলা করার সুযোগ থাকে না তাদের। ফলে হায়েনাদের গুলি আর বেয়েনেটের আঘাতে ঝরে পড়ে একে এক ২৭ মুক্তি পাগল যবকের প্রাণ, কামান্নার ব্যবসায়ি ফণিভূষণ কুন্ডু এবং গৃহবধূ রঙ্গনেছার। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ি কিরণ শিকদারের বাড়িতেও আশ্রয়ে ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন।
এলাকাবাসি জানান, ফণিভূষণ কুন্ডু প্রতিদিনের মতই নদির পাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়েছিলেন আর রঙ্গনেছা গিয়েছিলেন তার নতুন জামাইয়ের জন্য পিঠে বানানোর আতপ চাল ধুতে নদির ঘাটে। তাদের শত্রু ভেবেই হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। হানাদারদের গুলিতে আরো বেশ ক’জন মুক্তিপাগল যুবক আহতও হন। গুলিতে আহত আব্দুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনকে ওই সময় মায়ের মমতায় সেবা দিয়েছিলেন পানু কাজির মা রাবেয়া খাতুন ওরফে সোনা কাজি, ছোটবোন বেনু কাজি এবং কাজি সিরাজ। ইতিহাসের জঘণ্যতম হত্যাকান্ডের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা বারইহুদা গ্রামের কলেজছাত্র বিশ^াস লুৎফর রহমান যিনি পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব হয়ে অবসরে গেছেন, তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ছয়টি গণকবরে সমাহিত করেন মোমিন, কাদের, শহিদুল ইসলাম, সলেমান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল ওয়াহেদ, রিয়াদ, আলমগীর হোসেন, আব্দুল মোতালেব, আলী হোসেন, শরিফুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, আলিমুজ্জামান, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান, নাসিম, রাজ্জাক-২, কওসার আলী, আব্দুল মালেক, আব্দুল আজিজ, আকবর হোসেন, সেলিম, হোসেন, রাসেদ, গোলজার আহমেদ, অধির ও গৌরকে। এদের অধিকাংশই মাগুরা জেলার হাজিপুর ও শ্রীপুর উপজেলার সন্তান। গণকবরস্থানে একটি আধুনিক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। নির্মিত নতুন এ শহীদ মিনারে ২৭ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামের সাথে গৃহবধূ রঙ্গনেছার নামটিও শহীদ হিসেবে কেন লেখা হয়েছে তা আজও মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেনি। রক্তের কার্পেট এতই পুরু ছিল যে তা অপসারণেও সময় লাগে বহু। মাধব ভৌমিকের বাড়িটি অবশ্য এখন ওই গ্রামের কেবি জামান ওরফে পানু কাজি কিনে সংরক্ষণ ও বসবাস করছেন।
কামান্নায় ২৭ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ও গণকবর ঘিরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ ও এলাকাটিকে দেশের সব মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অবহিত করা, একটি বিশ^বিদ্যালয় এবং একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং উন্নতমানের রাস্তা নির্মাণের দাবি এলাকাবাসির দীর্ঘদিনের। গত ২০২১ সালে কামান্নায় ২৭ শহীদ স্মৃতি দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাড়িটির মালিক পানু কাজির ছেলে কাজি শাহিনুজ্জামান যিনি কাজি রাসেল নামে সমধিক পরিচিত, পাঁচ শতাংশ জমি দান হিসেবে লিখে দেন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের নামে। কামান্নায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বা মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মিত হবে এ কারণে জমিটি লিখে দেয়া হয় বলে জমিদাতা কাজি শাহিনুজ্জামান রাসেল জানান।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারি কমিশনার ভ’মি পার্থপ্রতীম শীল দানকৃত জমির দলিল বুঝে নেন। কিন্তু কি কারনে তার দান করা জমিতে স্মৃতি যাদুঘর বা কমপ্লেক্স না বানিয়ে আরেকটা স্মৃতিসৌধ বানানো হলো তার মানে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না বলে তিনি জানালেন এই প্রতিবেদককে।
কামান্না দিবস পালন উপলেক্ষ্যে অনুষ্ঠানের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান লাল ও খলিলুর রহমান জানালেন, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতি সংঘের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বগুড়া ইউনিয়ন ইউনিটের উদ্যোগেনির্বাচন কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব বিশ^াস লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)র অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খম আমির আলী প্রধান অতিথি এবং বাংলাদেশ মুৃক্তিযোদ্ধা সংসদ শৈলকুপা উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার রহমত আলী মন্টু বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের অনুরোধে কামান্নায় একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর স্থাপনের লক্ষ্যে কাজি শাহিনুজ্জামান ওরফে কাজি রাসেল তার নিজের ৫ শতাংশ জমি লিখে দিলে সেখানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৯শ ৫০ টাকা ব্যয়ে নির্মাণকাজ করার সময় একটি সাইনবোর্ড সেটে দিয়েছে “মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিবিজড়িত কামান্না বাড়ি স্মৃতিসৌধ”। অথচ, ১৯৭১ সালের ৬টি গণকবর ঘিরে ওই বছরই প্রতিষ্ঠা করা হয় কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতিসৌধ। আর সেটি নতুন করে বানাতে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে বছর দুয়েক হলো। একইস্থানে একই ঘটনায় দু’টি স্মৃতিসৌধ বানানোর মানে খুঁজে পাচ্ছেন না এলাকাবাসি, জমিদাতা কাজি রাসেল ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা অবিলম্বে নতুন স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর বা মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স তৈরির আবেদন জানিয়েছেন।