প্রভাতে শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশার চাঁদর, জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। দেশে গ্রামীণ জনপদে মৌসুমী খেজুরের রস দিয়েই শীতের আমেজ শুরু হয়। শীতকালে নতুন ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পিঠা পায়েস তৈরীতে খেজুরের রস ও গুড়ের কোন জুড়ি নেই। দেশের প্রাচীন জনপদ যশোর জেলা খেজুর গুড়-পাটালির জন্য সমাদৃত। বর্তমানে এর চাহিদা ও সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে। যে কারণে প্রবাদ আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। জেলার গাছিরা আগাম রস আহরণে এখন পুরোদমে খেজুর গাছ পরিচর্যা শুরু করে দিয়েছেন।
সুস্বাদু খেজুর রস ও গুড়-পাটালি তৈরির মূল কেন্দ্রবিন্দু জেলার খাজুরা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মৌসুম শুরু না হতেই এখানে খেজুর গাছ কাটা শুরু হয়েছে। যারা গাছ কাটায় পারদর্শী তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় গাছি বলা হয়। তারা কোমরে শক্ত মোটা দড়ি বেধে একেবারে গাছের মাথায় উঠছেন। পিঠে ঝুলানো ঠুঙিতে থাকা ধারালো গাছিদা (দা) দিয়ে গাছের এক পাশের ডাল কেটে বের করছেন সোনালী অংশ। যাকে স্থানীয়রা চাঁচ দেওয়া বলেন। এর সপ্তাহ খানেক পরেই বাঁশের তৈরি নলি স্থাপন শেষে ঠিলে (মাটির ভাড়) পেতে রস সংগ্রহ করা হবে। সব মিলিয়ে খুব তাড়াতাড়ি রস আহরণ করবেন এখানকার গাছিরা।
এলাকাবাসী জানান, যশোর সদরের লেবুতলা এবং বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ও রায়পুর ইউনিয়ন নিয়ে খাজুরা এলাকা। খেজুর গাছের আধিক্য থাকার কারণেই এখানকার নামকরণ ‘খাজুরা’ করা হয়েছে। এই এলাকার তেজরোল, রাজাপুর, ইছালী, গহেরপুর, কোদালিয়া, লেবুতলা, আগ্রাইল, মির্জাপুর, কুঠুরাকান্দি, সেকেন্দারপুর, রায়পুর, ভদ্রডাঙ্গা, মথুরাপুর, পার্বতীপুর, চন্ডিপুর, যাদবপুর, কেশবপুর, জহুরপুর, বেতালপাড়াসহ প্রায় ২৫টি গ্রামে রস সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মোটাদানার বিশেষ পাটালির জন্য বাওনডাঙ্গা ও তেজরোল প্রসিদ্ধ। এ গ্রামে যারা পাটালি তৈরি করেন এমন কারিগর দেশের আর কোথাও নেই বললেই চলে।
এলাকার সফল পাটালি উৎপাদনকারী তেজরোল গ্রামের নাজিম উদ্দীন জানান, ১ কেজি মোটদানার পাটালি তৈরি করতে কমপক্ষে ২শ’ টাকার বেশী খরচ হয়। কিন্তু আশানুরুপ দাম দিতে চাই না ক্রেতারা। এলাকার কিছু অসাধু লোক অল্প গুড় উৎপাদন করে তাতে অধিক চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে তা অল্প দামে বিক্রি করে থাকেন। এতে ভালো জিনিসের কদর থাকেনা। ফলে প্রকৃত গাছিরা এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
পার্বতীপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার মন্ডল নামে এক গাছি জানান, খেজুর রস ও গুড় আজ বিলুপ্তির পথে। কারণ ১ কেজি গুড় তৈরি করতে শ্রম ও জ্বালানিসহ তাদের খরচ হয় ৬০-৬৫ টাকা। আর প্রতি কেজি গুড় বাজারে বিক্রি করতে হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ কারণে গুড় বানাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন গাছিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সামাজিক সংগঠনের সভাপতি জানান, অবৈধ ইট-ভাটার আগ্রাসনে আগের তুলনায় এখন খেজুর গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবাধে ভাটা মালিকেরা খেজুর গাছ ধ্বংস করে চলেছে। জেলার প্রাচীন এই ঐতিহ্য রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
সদর ও বাঘারপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সদরে ১০৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৮২টি এবং বাঘারপাড়ায় ২৬৫ হেক্টর জমিতে ৯২ হাজার ৭৫০টি খেজুর গাছ রয়েছে।
বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আফরোজ জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে উপজেলার ৬০ জন গাছি নিয়ে একটি সংগঠন করা হচ্ছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উৎসাহ বাড়াতে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অন্যদিকে খেজুর গাছ রক্ষায় ও আধিক্য বৃদ্ধিতে চারা সংগ্রহের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন সড়কের দুপাশ দিয়ে চারা রোপণ করা হবে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান জানান, ভেজাল রোধে জেলা ও প্রতিটি উপজেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাবে। পাশাপাশি আসল গুড়-পাটালির গুণাগুণ ও ভেজালের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতনমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড চালানো হবে।