মির্জা ফখরুলের জামিন না হওয়ায় আইনজ্ঞদের প্রশ্ন

mirza fokrul

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমানে যে অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন, প্রায় একই রকমের ৯০টি মামলায় এর আগে তিনি জামিন পেয়েছেন। একই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি দলটির নেতা আমান উল্লাহ আমানসহ কয়েকজন জামিন পেলেও এজাহারে নাম না থাকা মির্জা ফখরুলের আবেদন চারবার নাকচ হয়েছে। ফলে তাঁর জামিন না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে আইন বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলে।

আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তি জামিন পাওয়ার অধিকারী। সেই হিসেবেও জামিন পাওয়ার যোগ্য মির্জা ফখরুল। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক কারণে তাঁর জামিন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। এতে আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, মির্জা ফখরুল দেশের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশের ঠিক আগের দিন তাঁকে গ্রেপ্তার এবং বারবার তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করায় জনমনে এই ধারণাই প্রবল হচ্ছে- তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

মির্জা ফখরুলের বয়স এখন ৭৬ বছর। তাঁর স্বজন ও আইনজীবীরা বলছেন, তিনি নানা রোগে ভুগছেন। তাঁকে গত ১০ বছরে সহিংসতা সৃষ্টি, বিস্ম্ফোরক বহন, গাড়ি পোড়ানো-ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা, সহিংসতায় হুকুমদানসহ নানা অভিযোগে মোট ৯২টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিএনপি এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছে। ইতোমধ্যে ৯০টিতেই জামিন পেয়েছেন তিনি। একটি মামলা খারিজ এবং সর্বশেষ রাজধানীর নয়াপল্টনের মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন আবেদন নাকচ হয়ে গেছে। একই ধরনের সব মামলায় জামিন পেলেও নতুন মামলায় কেন তাঁর জামিন হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

মির্জা ফখরুলের আইনজীবীরা বলছেন, সামাজিক অবস্থান, বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। জামিন না দিয়ে ন্যায়বিচার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, পল্টন থানায় পরিকল্পনা ও প্ররোচনার অভিযোগে করা মামলার দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারা জামিন অযোগ্য। এ কারণে তাঁর জামিন হচ্ছে না।

পল্টন থানার মামলায় সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুলের জামিন নামঞ্জুর করেন ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর আদালত।

বিএনপির দাবি, আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম জামিনে থাকা মামলাগুলোতে প্রতি মাসেই হাজিরা দিতে আদালতে যান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি কারাগারে গেছেন অন্তত ছয়বার। একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাঁকে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক বছর তাঁকে জেলেই থাকতে হয়েছে। এবারও গ্রেপ্তারের পর মির্জা ফখরুলের মতো হেভিওয়েট নেতাদের কারা ডিভিশন নিতে বেগ পেতে হয়েছে। উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তাঁদের। সেলের বাইরে তাঁদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ বিএনপির।

আইনজ্ঞদের মত :ব্লাস্টের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, জামিন না দেওয়া এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বোঝা যায়, বিচারব্যবস্থা অচল এবং এর পরিবর্তন আবশ্যক। আদালতকে তাঁর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচারপ্রার্থী কোনোভাবেই যেন হয়রানির শিকার না হন, তা বিবেচনা করতে হবে। মামলার এজাহারে যাঁর নাম নেই, সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই। অভিযোগের সম্পৃক্ততাও আদালতে প্রমাণ করতে হবে। সম্পৃক্ততা থাকলে আদালত তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিতে পারেন। রাষ্ট্রপক্ষের বিরোধিতার কারণে জামিন না দেওয়াটা সঠিক নয়। এভাবে বিচারব্যবস্থা চলতে পারে না। প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। নয়তো আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।

মির্জা ফখরুলের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, আইনগতভাবে মির্জা ফখরুল জামিন পাওয়ার যোগ্য। শুধু রাজনৈতিক কারণেই তাঁকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। মির্জা ফখরুল একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। তিনি বোমাও মারেননি, তাঁর কাছে বোমা পাওয়াও যায়নি। জয়নুল আবেদীন জানান, উচ্চ আদালতের অবকাশকালীন ছুটি শেষ হলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জামিনের জন্য আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।

 

ফৌজদারি মামলার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মির্জা ফখরুলকে যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সেখানে এজাহারে তাঁর নাম নেই। মামলার এজাহারে তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ নেই। এজাহারে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের মধ্যে দু’জন জামিনে গেছেন। একই আদালত মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদন নাকচ করছেন। এখানে মনে হয়, নিম্ন আদালত হয়তো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। বয়স ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় আদালত তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিতে পারতেন।

ফখরুলের আরেক আইনজীবী সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ সমকালকে বলেন, বিএনপি অফিসের সামনে কথিত ঘটনার ১৪ ঘণ্টা পর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এখানে মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। তার পরও তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। জামিন পাওয়া তাঁর আইনি অধিকার। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় উল্লেখ আছে- কাকে, কখন, কীভাবে জামিন দিতে হবে।

অবশ্য ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই জামিন অযোগ্য ধারা। সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, ভাঙচুর করা- এসবই জামিন অযোগ্য ধারা। তা ছাড়া সব মামলার আসামি এক রকম থাকে না। মামলায় ফখরুলের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, উস্কানিদাতা ও নির্দেশদাতার অভিযোগ আসছে। কাকে জামিন দেবে, কাকে দেবে না- এটি আদালতের এখতিয়ার। পিপি আরও বলেন, সরকারের প্রভাব থাকলে আমান উল্লাহ আমানসহ দু’জনের জামিন হতো না। ফখরুলের অসুস্থতার কথা বলা হয়েছিল; আমরাও আদালতে বলেছি। কিন্তু যে মেডিকেল কাগজপত্র আদালতে দিয়েছে, সেগুলো পুরোনো। সাম্প্রতিক সময়ের কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট তাঁরা আদালতে দিতে পারেননি।

জানা গেছে, এর আগে টানা ছয় মাস কারাভোগের সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মির্জা ফখরুলকে দ্রুত সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে হয়েছে। মির্জা ফখরুলের স্ত্রী রাহাত আরা গত সপ্তাহে কারাগারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওষুধপত্র ও কিছু বই দিয়ে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মির্জা ফখরুলের শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তিনি স্বামীর জন্য দোয়া করতে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন। ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, কারাবন্দি নেতাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। তাঁদের ২৪ ঘণ্টা লকআপে রাখা হচ্ছে।

বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ৪৭৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় দেড় থেকে ২ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধর, কাজে বাধাদান, ভাঙচুর ও বিস্ম্ফোরক দ্রব্য আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। পরদিন ভোর রাতে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে নিজ নিজ বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে পুলিশ। প্রায় সাত ঘণ্টা তাঁরা সেখানে থাকলেও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার কথা বলেনি পুলিশ। তবে ৮ ডিসেম্বর পুলিশ জানায়, ৭ ডিসেম্বরের নাশকতায় উস্কানি দেওয়ায় ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর পর সিএমএম আদালত ও মহানগর আদালতে দফায় দফায় তাঁদের জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যায়।